
বেগম রোকেয়া দিবস নারীর অধিকার, স্বাস্থ্যের সুরক্ষা, বৈষম্যহীন সমাজ এবং নারী নেতৃত্বের অগ্রযাত্রাকে স্মরণ করার একটি প্রতীকী দিন। আজকের এই দিনে আমরা স্মরণ করি রোকেয়ার সেই প্রগতিশীল চিন্তা যে চিন্তা নারীর মুক্তি, শিক্ষার বিস্তার এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
এই প্রেক্ষাপটে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনীর দাবি শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয় নয়-এটি নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নারীর অধিকার এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব নারীদের ওপর বহুগুণ বেশি দেখা যায় পরোক্ষ ধূমপানের ভয়াবহতা, দরিদ্র পরিবারে স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের ঝুঁকি, এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপানজনিত স্বাস্থ্যহানির মাধ্যমে নারীরা প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টোব্যাকো এটলাস ২০২৫ অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ৯২ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহার করে এবং প্রতিবছর তামাকের কারণে ১ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়_যা প্রতিদিন ৩৫৭ জনের মৃত্যুর সমান। এই মৃত্যু ও রোগ-ব্যাধির বড় অংশের সরাসরি ও পরোক্ষ ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা।
তামাকজনিত রোগ, অর্থনৈতিক ক্ষতি (৩৯.২ হাজার কোটি টাকা) এবং সামাজিক বৈষম্য নারীর উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে-যা বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই নারীর স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে প্রস্তাবিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনী দ্রুত পাশ করা জরুরি।
প্রস্তাবিত সংশোধনী ও নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এর গুরুত্ব
১. শতভাগ ধূমপানমুক্ত পাবলিক প্লেস ও পরিবহন
নারীরা রেস্তোরাঁ, অফিস, গণপরিবহন সব জায়গায় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে নারীকর্মীরা (৪২.৭%), রেস্তোরাঁয় (৪৯.৭%) এবং গণপরিবহনে (৪৪%) পরোক্ষ ধূমপানজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। সংশোধনীতে স্মোকিং জোন বাতিল হলে নারীদের হৃদরোগ ও স্ট্রোক ঝুঁকি ৮৫% পর্যন্ত কমে যাবে।
২. তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শনী, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করা:
বিক্রয়কেন্দ্রে প্রদর্শন, রঙিন প্যাকেট বা বিজ্ঞাপন তরুণীদের জন্য তামাককে “সহজলভ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলে। সংশোধনীর মাধ্যমে নারী ও কিশোরীদের ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
৩. তামাক কোম্পানির সিএসআর নিষিদ্ধ করা:
তামাক কোম্পানি সিএসআরের মাধ্যমে নিজেদের “সামাজিকভাবে ভালো প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরে নীতিনির্ধারণ প্রভাবিত করে। এটি জনস্বাস্থ্য ও নারীর স্বাস্থ্য অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সংশোধনীতে এই সুযোগ বন্ধ হলে নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা আরও শক্তিশালী হবে।
৪. সিগারেট এর খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করা:
স্কুল-কলেজগামী কিশোরী ও তরুণদের জন্য এটি একটি বড় সুরক্ষা।
সিঙ্গেল স্টিক নিষিদ্ধ হলে দরিদ্র নারীদের পরিবারে তামাক কেনার প্রবণতা কমবে এবং পরিবারে অর্থ অপচয় কমবে।
৫. ই-সিগারেট, এইচটিপি ও নিকোটিন পণ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
নতুন ধরণের আসক্তি তৈরি করে এমন এসব পণ্য তরুণীদের জন্য বড় ঝুঁকি।
১০৯টি দেশের মতো বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ করা হলে কিশোরী ও যুব নারীরা আসক্তির ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবে।
৬. তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটে ৯০% সচিত্র সতর্কবার্তা
বাংলাদেশে বর্তমানে সতর্কবার্তা মাত্র ৫০%, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম।
সতর্কবার্তার আকার বাড়ালে নারীরা পরিবারে তামাক ত্যাগে পুরুষ সদস্যদের উৎসাহিত করতে আরও সক্ষম হবেন।
পরিশেষে,
বেগম রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনী দ্রুত পাশ করা জরুরি।
এই সংশোধনী-
প্রস্তাবিত সংশোধনী বাস্তবায়িত হলে শুধু তামাকের ব্যবহার কমবে না, তামাকজনিত বছরে ১ লক্ষ ৩০ হাজার মৃত্যুও কমানো সম্ভব হবে।
বেগম রোকেয়ার ভাষায়-
নারীশিক্ষা ও নারীস্বাস্থ্য জাতির উন্নতির মূলভিত্তি।
তাই নারীর স্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে এই আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবি, জাতির দাবি।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply