তুহিন,বরিশাল প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের রক্ষা করুন। ভোলা থেকে পাইপলাইনে যে গ্যাস দেয়ার ওয়াদা করেছেন তা পূর্ণ করুন। এলপিজি গ্যাসের প্রতিদিনের দাম বৃদ্ধি থেকে আমাদের বাঁচান। এলপিজি এখন গলার ফাঁস হয়েছে – এমনটাই কাকুতি মিনতি বরিশালের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি নেতৃবৃন্দেরও।
গত রোববার চলতি বছর চারমাসে তৃতীয়বারের মতো বাড়ানো হলো এলপিজি গ্যাসের দাম। এক মাসের ব্যবধানে এলপি গ্যাসের নতুন দাম অনুযায়ী ১২ কেজি সিলিন্ডার এখন ১ হাজার ৪৩৯ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যা আগে ছিল ১ হাজার ৩৯১ টাকা। এছাড়া অটোগ্যাসের মূল্য লিটার প্রতি ৬৭.০২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি বছর এপ্রিল মাসে (সৌদি আরামকো) যথাক্রমে প্রতি টন প্রোপেন ৯৪০, বিউটেন ৯৬০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। যদিও বিশ্ববাজারে ২০২১ এর জানুয়ারি মাসে বাজারদর প্রতি টন প্রোপেন ৫৫০ ডলার ও বিউটেন ৫৩০ ডলার নির্ধারিত ছিলো।
অর্থাৎ ২০২০ সালের একই সময়ের চেয়ে প্রতিটন প্রোপেনে ১৫ ডলার ও বিউটেনে ৬০ ডলার করে কম। তখন বাংলাদেশের বাজারে কিন্তু পাঁচমাসে পাঁচ বার বেড়েছে এলপিজির দাম। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে প্রোপেনের দাম পুনরায় বাড়লেও তা ভর্তুকি দেয়ার পরামর্শ ছিলো জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ঘটেছে। এটা সাময়িক। যুদ্ধ শেষে দাম স্বাভাবিক হয়ে যাবে কমেও যেতে পারে। তাই সরকারের উচিত কর কমানো ও এই খাতে ভর্তুকি দেয়া।
এদিকে বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, সরকার নির্দারিত দামে যাতে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়, সেজন্য সামনের দিনগুলোতে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করবে বিইআরসি। শুধু খুচরা বিক্রেতা কিংবা ডিলার নয়, বেশি দামে বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেলে কোম্পানির বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ একমাসে ১৫১ টাকা বাড়িয়ে চলতি মার্চ মাসের জন্য ১২ কেজির এক সিলিন্ডার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৯১ টাকা।
একমাস পার হতে না হতেই তা আবারও বেড়ে ১৪৩৯ টাকা হয়েছে। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ইউক্রেন সংকটকে দায়ী করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। গত বছরের ১২ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করেছিল এ সংস্থা। এর পর থেকে প্রতি মাসে একবার দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।
এই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধাবস্থায় দাম বাড়লেও চাহিদা মেটাতে কোনো সমস্যা হবে না বলেও আশ্বস্ত করেছে সংস্থাটি। এদিকে চলমান জ্বালানি সঙ্কটেও অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে ভোলায় মজুদ বিপুল পরিমাণ গ্যাস। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে দ্বীপ জেলা ভোলার ভেদুরিয়ায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়। এ ছাড়া এখানকার পুরনো শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের মজুদও বেড়েছে বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে ভোলায় এখন প্রায় দুই/তিন ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে ধারনা জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের।
২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই গ্যাস বরিশাল ও খুলনায় নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুটি প্রকল্প প্রণয়ন করেছিল জিটিসিএল। যা নিয়ে ২০১৮সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম আলোসহ সব মিডিয়া সংবাদ করেছে। যার একটি হলো ৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভোলা থেকে বরিশাল সঞ্চালন লাইন প্রকল্প। এতে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকায় ২৮ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন বসবে, যা দিয়ে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। এই লাইন নির্মাণের সময় ধরা হয়েছিল ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। যার কিছুই এখন পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয়নি।
পটুয়াখালীর পায়রাতে এলএনজি টার্মিনাল তৈরি, এলএনজি থেকে প্রাপ্ত গ্যাস নিতে খুলনা পর্যন্ত তিনটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণে জিটিসিএল-এর প্রস্তাবনাগুলোর কি হলো? পায়রা বন্দর থেকে খুলনা পর্যন্ত ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসবে যা ৭৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস পরিবহনে সক্ষম হবে।
বাস্তবায়নকাল ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া এবং জাজিরা-গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনা পর্যন্ত আরেকটি সঞ্চালন লাইন হবার কথা। এতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই পাইপলাইন দিয়ে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তৃতীয় পাইপলাইনটি হবে সাতক্ষীরার ভোমরা থেকে খুলনা পর্যন্ত।
৯শ’ কোটি টাকার প্রকল্পটির মাধ্যমে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। গ্যাস নিতে পারবে ৭০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত। বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। জিটিসিএল এর এই প্রকল্প কোথায় কি অবস্থায় আছে তার কোনো তথ্য বরিশালবাসীর জানা নেই। অথচ প্রকল্প তথ্য অনুযায়ী এতোদিনে বরিশালবাসীর গ্যাসে রাজ্যে বসবাসের কথা ছিলো।
বাস্তবে এর কিছুই জোটেনি। এলপিজি গ্যাসের ফাঁসটুকু ছাড়া। জিটিসিএল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানালেন আব্দুর রাজ্জাক নামের কর্মকর্তা। আর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোঃ হেলাল উদ্দিন, এনডিসি বরিশালের গ্যাস নিয়ে কথা বলতে রাজী নন। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আশ্বাস দিলেন তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনবেন।
এ দিকে বরিশাল ক্ষুদ্র কুটির শিল্প (বিসিক) মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জেআইবি এগ্রো ফুডসের মহাব্যবস্থাপক ইব্রাহিম খান বলেন, বরিশাল বিসিক দেশের অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো, যদি আমাদের পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধা থাকতো। গ্যাসের অভাবে এখানে বাসাবাড়িতে রান্নাটাই কষ্টকর, সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান কি করে টিকবে? এলপিজি দিয়ে আর যাই হোক বাণিজ্যিক ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না।
বরিশালের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের কথা দিয়েছেন, তিনি ভোলা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বরিশালবাসীকে গ্যাস দেবেন। আমরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
দক্ষিণাঞ্চলের রাজনৈতিক অবিভাবক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এই গ্যাস আনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সুপারিশ করেছিলেন। তাই এটা হয়তো শীঘ্রই আশা করতে পারি আমরা।
সাইদুর রহমান রিন্টু আরো বলেন, এভাবে এলপিজি গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষই নয় বরিশালের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হলে বাণিজ্যিক বরিশালের প্রধান সমস্যাই হবে এই গ্যাস।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply