কাতারের আল বায়াত স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের শেষ কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে শেষ চারে জায়গা করে নিয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স৷ সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ আফ্রিকার একমাত্র প্রতিনিধি মরক্কো৷
বিশ্বকাপ ফুটবলে দুই দল যখন মুখোমুখি, তখন অনেকেরই শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা৷ ফরাসি অধিনায়ক হুগো লরি আর ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেইন, দুজনেই একসঙ্গে খেলেন টটেনহামে৷ অথচ এখন একজনের গোলে নেয়া শট অন্যজনকে বাঁচাতে হচ্ছে৷ রাফায়েল ভারান খেলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে, ইংল্যান্ডের হ্যারি ম্যাগুয়ারকে পাশে নিয়েই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে খেলেন এই ফরাসি৷ অথচ আজ দুজনের দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে! অলিভিয়ের জিরদের জীবনের গত ১২ বছরের ১০ বছরই কেটেছে লন্ডনে৷
বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে, ঘনিষ্ঠ শত্রুদের এই দ্বৈরথে প্রথম গোলটা অরেলিয়ান চুয়ামেনির৷ মাসখানেক আগে, জুন মাসেই মোনাকো থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরোতে এই মিডফিল্ডারকে দলে নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ৷ বিশ্বকাপে চুয়ামেনি এত ভাল খেলছেন যে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সবশেষ মৌসুমে রিয়ালের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গার একাদশে জায়গা হচ্ছে না৷ ফ্রান্সকে ম্যাচের ১৭ মিনিটে গোলের দেখা পাইয়ে দিলেন সেই চুয়ামেনিই৷ বুকাইও সাকার কাছ থেকে চ্যালেঞ্জে বল কেড়ে নিয়ে দিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পেকে, এমবাপ্পে আবার দিলেন উসমান দেম্বেলেকে, তার কাছ থেকে আন্তোয়ান গ্রিয়েজমান হয়ে ফের চুয়ামেনির পায়ে বল৷ ২৫ গজ দূর থেকে চুয়ামেনির শটটা জর্ডান পিকফোর্ড সমস্ত শরীর ডানদিকে ভাসিয়েও ঠেকাতে পারেননি৷
এরপর প্রথমার্ধে ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন হ্যারি কেইন, এমবাপ্পেরও শট জমা পড়ে পিকফোর্ডের হাতে৷ দুই দলই আক্রমণ পালটা আক্রমণ জারি রাখে, কিন্তু গোল আর হয়নি৷ দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরুর সাত মিনিটের মাথায় বক্সের ঠিক মাথায় সাকাকে ফাউল করলেন সেই চুয়ামেনি, বুটের ডগা দিয়ে ল্যাং মেরেই ফেলেছেন৷ সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির সংকেত রেফারির৷ ১২ গজ দূরে মুখোমুখি দুই বন্ধু, কেইন আর লরি৷ টটেনহামে দুজনের গলায় গলায় ভাব৷ কাল বন্ধুর বিপক্ষে শটটা নিতে গিয়ে একবার থামলেন কেইন, বলটা আবার বসিয়ে মোজাটা টেনে ঠিক করে আবার দৌড়ে এসে শট নিলেন৷ বুলেট গতির সেই শটে থামানোর সাধ্য পৃথিবীর কোন গোলরক্ষকেরই নেই৷
গোল হজমের পরই যেন ফের তেতে উঠল ফ্রান্স৷ বাম প্রান্ত দিয়ে এমবাপ্পে যে দৌড়টা দিলেন, সেটা আল খোর স্টেডিয়াম না হয়ে টোকিও অলিম্পিকে দিলে নির্ঘাৎ ১০০ মিটারে পদক পেতেন৷ যে ক্রসটা করলেন, দেম্বেলে তাতে পা ছোঁয়াতে পারলে গোল হয়, কিন্তু দেম্বেলে যে গতিতে এমবাপ্পের সমকক্ষ নন৷ দৌড়ে বক্সে এসে ঢোকার আগেই বল চলে গেছে বাইরে৷ পরের মিনিটে আদ্রিয়ান রাবিওর জোরাল ভলিও আটকে দিয়েছেন পিকফোর্ড৷ সুযোগ পেয়েছে ইংল্যান্ডও৷ ফ্রি-কিকে হ্যারি ম্যাগুয়ারের হেডটা লরির আওতার বাইরেই ছিল, গোলপোস্টে চুমু খেয়ে চলে গেছে গোললাইনের বাইরে৷
৭৬ মিনিটে ম্যাচের সবচেয়ে সেরা সেভটা করেছেন পিকফোর্ড৷ এমবাপ্পের ক্রস, দেম্বেলে হেডে সেটা মাটিতে নামালেন, একদম পিকফোর্ডের মুখের সামনে থেকে জিরুদের জোরাল ভলি ইংল্যান্ড গোলরক্ষক কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করলেন৷ সেই কর্নারই অবশ্য কাল হল৷ কর্নারের ক্লিয়ারেন্সে বল বক্সের বাইরে চুয়ামেনির পায়ে, দিলেন বামে থাকা গ্রিয়েজমানকে৷ গ্রিয়েজমানের মাপা ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন জিরদ৷ নির্ধারিত সময় শেষের ১২ মিনিট আগে ফের এগিয়ে যায় ‘লে ব্লু’রা৷
সেই অগ্রগামিতাও থাকত না, যদি না কেইন ম্যাচে দ্বিতীয়বারের মত পেনাল্টি নিতে যেতেন এবং মিস করতেন৷ ৭৯ মিনিটে মাঠে নামা মেসন মাউন্ট বক্সের ভেতর লংবলের আশায় ছুটছিলেন, এমন সময় পেছন থেকে অনেকটা দৌড়ে এসে তাকে ধাক্কা মারেন থিও হার্নান্দেজ৷ শুরুতে রেফারি এড়িয়ে গেলেও ভিএআরে দেখে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত জানান৷ আবারও কেইন-লরি মুখোমুখি৷ তবে এবারে কেইন পোস্টের উপর দিয়ে উড়িয়ে বল নিয়ে ফেললেন গ্যালারিতে৷ তাতে চুপসে যাওয়া ফুসফুসে হাওয়া ফিরে এল ফরাসিদের৷
বাকি সময়টায় আর কোন বিপদ নয় ফরাসিদের৷ একদম শেষ মুহূর্তে, বক্সের ঠিক বাইরে ফ্রি-কিক পেয়েছিল ইংল্যান্ড৷ মার্কাস রাশফোর্ডের নেয়া শটটা অল্পের জন্য ক্রসবারের উপর দিয়ে গিয়ে লাগে জালে৷ এরপর বল মাঠে ফিরতেই রেফারির লম্বা বাঁশি৷
অপরদিকে পর্তুগালকে হারিয়ে আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নাম লেখানোর ইতিহাস গড়ল মরক্কো। আল-থুমামা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে দলটির জয় ১-০ গোলে। ভাগ্য নির্ধারণী একমাত্র গোলটি করেন ইয়াহিয়া আত্তিয়াত।
টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে বেঞ্চে রেখে একাদশ সাজান পর্তুগাল কোচ ফার্নান্দো স্যান্তোস। সাবেক ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড সুপারস্টারের পরিবর্তে একাদশে এসে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করা গঞ্জালো রামোস এ ম্যাচের আগে পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন। কিন্তু ৬৯ মিনিটে মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন বেনফিকা ফরোয়ার্ড। সেন্টার ব্যাক পেপে, রাইট ব্যাক দিয়েগো দালোত, মিডফিল্ডার বের্নার্দো সিলভা, উইংয়ে ব্রুনো ফার্নান্দেজ ও জোয়াও ফেলিক্স শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলো ছাড়িয়ে গেছেন। বাকিরা সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেনি; এ কারণেই হয়তো সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে খুনে মেজাজের পর্তুগালকেও মাঠে দেখা গেলনা। তারপরও গোল হজমের পর থেকে একের পর আক্রমণ গড়ে গেছে ইউরোপিয়ান জায়ান্টরা।
পঞ্চম মিনিটে জোয়াও ফেলিক্সের ডাইভিং হেড দারুণ দক্ষতায় রুখে দিয়েছেন মরক্কো গোলরক্ষক ইয়াসিন বুউনো। সপ্তম মিনিটে পাল্টা আক্রমণে ভালই জবাব দেয় মরক্কো। ৩১ মিনিটে জোয়াও ফেলিক্সের ভলি ফিরিয়ে দেয় মরক্কো রক্ষণভাগ। প্রথমার্ধে পর্তুগাল ৬৫.৮ শতাংশ বল দখলে রাখলেও ম্যাচে মরক্কো ছিল প্রায় নিখুঁত। ২০১৬ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নদের ৫ শটের বিপরীতে উত্তর আফ্রিকার দেশটি শট সংখ্যা ছিল ৭। যার দুটি ছিল অন-টার্গেট, টার্গেটে পর্তুগাল একটি শট নিতে পেরেছে। বিরতির পর বলের ওপর দখল বাড়ানো পর্তুগাল অন্যান্য পরিসংখ্যানেও এগিয়ে ছিল। কিন্তু দিন শেষে এসব পরিসংখ্যান গৌণ, ফুটবলে গোলটাই মুখ্য। সে দৃষ্টিকোণ থেকে শতভাগ সফল মরক্কো।
৪২ মিনিটে ইয়াহিয়া আত্তিয়াতের হেড প্রতিহত করতে আসা সেন্টার ব্যাক রুবেন দিয়াস ও গোলরক্ষক দিয়েগো কস্তার ভুল বোঝাবুঝির ফায়দা তুলে এগিয়ে যায় মরক্কো (১-০)। যোগ করা সময় মিলিয়ে ম্যাচের বাকি প্রায় ৫৬ মিনিট সর্বস্ব উজাড় করেও পতন রুখতে পারেনি পর্তুগাল। শেষপর্যন্ত এ গোলই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। স্বপ্ন যাত্রায় কানাডা ও বেলজিয়ামকে আল-থুমামা স্টেডিয়ামেই হারিয়েছে ওয়ালিদ রেগ্রাগুইয়ের দল। এ ভেন্যুতে মরক্কোর এটি হ্যাটট্রিক জয়।
তিন বছর আগে মিসরে আফ্রিকান নেশনস কাপে বেনিনের কাছে হারা দলটি বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে এক ম্যাচ দূরে! ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে গ্যালারিতে আসা মরক্কান সমর্থকদের উচ্ছ্বাস, উৎসব ছিল উপভোগ্য। ১৯৮৬ সালে এই পর্তুগালের বিপক্ষেই বিশ্বকাপে মরক্কোর প্রথম জয় আসে। সেই পর্তুগালের বিপক্ষে আরেক ইতিহাস রচনা করল দেশটি। ম্যাচে মরক্কো লিড নেয়ার পর দ্রুতই পাল্টা জবাব দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন ব্রুনো ফার্নান্দেজ। বক্সের ওপর থেকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড প্লে-মেকারের করা ফ্লিক বুইনোকে ফাঁকি দিলেও ক্রসবারে বল প্রতিহত হয়।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে পর্তুগাল। সময়ের সঙ্গে ফার্নান্দো সান্তোসের দলের আক্রমণ বেগবান হলেও তার সুফল আসেনি। প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলাতে সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারের নায়ক গোলরক্ষক ইয়াসিন বউনো। ৮৩ মিনিটে দূরের পোস্টে জোয়াও ফেলিক্সের দারুণ শট রুখে দেন ৩১ বছর বয়সি সেভিয়া গোলরক্ষক। যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে রোনাল্ডো হতাশ করেন মরক্কো গোলরক্ষক।
বিশ্বকাপে দলটির বিপক্ষে কোন দলই গোল করতে পারেনি! গ্রুপ পর্বে কানাডার বিপক্ষে একমাত্র গোলটি ছিল আত্মঘাতী। কাজটা পর্তুগালের জন্যও অসম্ভব করে তুলল মরক্কোর রক্ষণ ও গোলরক্ষক। যোগ করা সময়ে ওয়ালিদ চেদ্দিরা দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে দশ জনের দলে পরিণত হওয়ার পর গোল না খাওয়ার রেকর্ড ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। কিন্তু দলগত প্রচেষ্টায় একজনের অভাব ঢেকে দিয়ে ইতিহাস রচনা করে মরক্কো। রক্ষণ সামলে দ্রুত পাল্টা আক্রমণে গিয়ে দুটি দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করেছিল মরক্কো। দুটি প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছেন পর্তুগাল গোলরক্ষক কস্তা। আগেই অল-ইউরোপিয়ান সেমিফাইনালের পথ বন্ধ করে দিয়েছে আর্জেন্টিনা। মরক্কো উঠে এসে বিশ্বকাপে আফ্রিকার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখল।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply