কাতারে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার দিন কয়েক আগে ফিফার সাবেক সভাপতি সেপ ব্লাটার জানিয়েছিলেন, কাতারকে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তবে তিনিই প্রথম ব্যক্তি নন, বরং কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নেতিবাচক প্রচারণায় মুখর পশ্চিমা দেশগুলো। আরব ও মুসলিম বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে ক্ষুদ্র দেশটি। দারুণ জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রোববার (২০ নভেম্বর) বিশ্বকাপের উদ্বোধন হয়ে গেলেও থামেনি দেশটির সমালোচনা।
২০১০ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয় কাতার। এই বিডিংয়ে কাতারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দৌড়ে বরং যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত ভোটাভুটিতে ১৪-৮ ব্যবধানে জয় পায় কাতার।
বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকেই কাতারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় লিপ্ত হতে দেখা যায় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোকে। এমনকি, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশটি বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি তারা।
কাতারের বিপক্ষে বেশকিছু অভিযোগ এনে বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক পর্যন্ত দিয়েছে দেশগুলো। মূলত গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, নারী স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে দেশটির অবস্থান, ইসলামি শরীয়াহ আইন, এলজিবিটিকিউ -এর বিপক্ষ অবস্থান ও অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি দেশটির আচরণ নিয়েও আপত্তি তাদের।
এই বিরোধিতা আরও উস্কে দিয়েছে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর নেতিবাচক প্রচারণা। বিবিসি, গার্ডিয়ানের মতো গণমাধ্যম প্রায়ই নানা ইস্যুতে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে।
বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগের দিন ফিফার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো কাতারের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের আচরণকে কড়া ভাষায় ধুয়ে দেন। কাতারে মানবাধিকারের অবস্থা নিয়ে পশ্চিমাদের মরাকান্নাকে স্রেফ ‘ভণ্ডামি’ বলে অবিহিত করেন তিনি। তিনি বলেন, গত ৩ হাজার বছরে ইউরোপিয়ানরা সারাবিশ্বে যা যা করেছে, তাতে আগামী ৩ হাজার বছর তাদের শুধু ক্ষমা চেয়ে বেড়ানো উচিত।
তবে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছে গুটিকতক গণমাধ্যম। দ্য ইকোনমিস্ট -এ এক লেখায় কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বপক্ষে যুক্তিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। স্কটিশ গণমাধ্যম দ্য হেরাল্ডেও পশ্চিমাদের প্রচারণার সমালোচনা করা হয়েছে।
কাতারের বিপক্ষে নানা অভিযোগে এনে বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক দেওয়াটাকে তারা ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বলে গণ্য করছেন। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, যৌন স্বাধীনতার অভাব, অভিবাসী শ্রমিকদের নির্যাতনের একই অভিযোগ রাশিয়া বা চীনের বেলাতেও থাকলে তাদের বেলায় পশ্চিমাদের চুপ থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তারা। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করেছিল। ২০০৮ সালে অলিম্পিকের আয়োজক হয়েছিল চীন।
কাতারের যে সব সমালোচনা করে পশ্চিমারা, তাতে অনেক খুঁত আছে বলে এই লেখাগুলোয় দাবি করা হয়। পশ্চিমারা কাতারকে যেভাবে স্বৈরাচারী রাষ্ট্র মনে করে সেখানে গলদ আছে। কাতার কিংবা আরব রাষ্ট্র নিয়ে অনেক সিদ্ধান্তই তারা নেয় কুসংস্কার বা ভুল ধারণা থেকে। এমনকি, পশ্চিমারা ধনী কিংবা মুসলমান দেশ বলেই কাতারকে অপছন্দ করে -এমন তীর্যক মন্তব্যও তারা করেছে এইসব লেখায়।
চীন ও রাশিয়ার গণতন্ত্রহীনতার সঙ্গে কাতারের রয়েছে সুস্পষ্ট পার্থক্য। কাতারের ভূতপূর্ব আমির কোন ধরনের চাপ ছাড়াই এক ধরণের নির্বাচন প্রক্রিয়া অন্তত চালু করেছেন। কাতারের আছে আল জাজিরার মতো আন্তর্জাতিক মানের গণমাধ্যম। সে তুলনায় রাশিয়া বা চায়নায় গণতন্ত্র বা গণমাধ্যমের বিষয়টি আরও বেশি অনুপস্থিত।অভিবাসী শ্রমিক নিয়েও পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করা হয়েছে। কাতারের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ ভাগ কাতারি। বাকিদের সবাই মূলত দেশটিতে কাজ করতে আসা অভিবাসী শ্রমিক। ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় কাতারে কাজের সুযোগও বেশি। শ্রমিক নির্যাতনের বিষয়টি পুরোপুরি মিথ্যা না হলেও এইখানে কাজ করে যা আয় করে তারা, তাতে তাদের জীবনও বদলে গেছে বলে দাবি তাদের।
গণমাধ্যম দুটির যুক্তি, চীন দুবার অলিম্পিক আয়োজন করেও দেশটিতে গণতন্ত্রের কোন উন্নতি হয়নি, কিন্তু বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে কাতারে শ্রম আইনের উন্নতি হয়েছে। বাতিল হয়েছে কাফালা সিস্টেম।
হোমোফোবিয়া নিয়ে যে অভিযোগ তাও কাতারের বিরুদ্ধে একপেশে আচরণ বলে মত ইকোনমিস্ট-হেরাল্ডের মতো গণমাধ্যমের। সমকামিতা যে কাতারে নিষিদ্ধ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে শুধু কাতার নয়, প্রায় সব মুসলিম দেশেই নিষিদ্ধ সমকামিতা। একইভাবে বিয়ের বাইরে যে কোন সম্পর্ক অবৈধ দেশটিতে। তবে কাতারে এসব আইন ভঙ্গের দায়ে বিচারের ঘটনা কম।
কাতারের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগকে পশ্চিমাদের ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বলে মনে করেন ‘দ্য হেরাল্ড’ -এর সাবেক উপসম্পাদক কেভিন ম্যাককেনা। তিনি লিখেছেন, সৌদি আরবেও সংখ্যালঘু ও নারীরা নিপীড়নের শিকার হন। অথচ সেই দেশটি যুক্তরাজ্যের মিত্র দেশ। যৌনতা, সমকামিতা নিয়ে দেশটির আইন, খাশোগি হত্যায় মোহাম্মদ বিন সালমানের সম্পৃক্ততা, এসব নিয়ে কখনোই উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমা দেশগুলোকে।
বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কাতার অসদুপায় অবলম্বন করেছে – এমন অভিযোগ সত্য ধরে নিলেও তার প্রমাণ জনসমক্ষে দিতে পারেনি পশ্চিমা দেশগুলো। বরং ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের দাবি সত্য হলে কাতারের চেয়ে ফিফার দুর্নীতির দায় বেশি বলে মত তাদের।
কাতারের বিরুদ্ধে আছে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের অভিযোগও। উষ্ণ মরুর দেশ হওয়ায় কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামগুলোয় ব্যবস্থা করেছে কুলিং সিস্টেমের। যার কারণে প্রচুর কার্বন নিঃসরণ হবে বলে অভিযোগ তুললেও ফিফা বলছে , কাতার বিশ্বকাপে হওয়া কার্বন নিঃসরণ এ বছর হওয়া বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মোটে ০.০১ শতাংশ।
উষ্ণতাকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বকাপ করতে চাইলে ফিফাকে নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডের মতো দেশ বেছে নেওয়া ছাড়া অপশন নেই বলে অভিমত গণমাধ্যমগুলোর। তাতে বিশ্বকাপের সার্বজনীন পরিচয় কতটা থাকবে তা নিয়েও থাকে প্রশ্ন। ফুটবলকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাইলে এটাকে বৈশ্বিকভাবে দেখতে হবে বলে মত তাদের। এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতারই সর্বোত্তম বিকল্প বলেই তারা মনে করেন।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply