বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন

জেলে কার্ড পাওয়া বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা ও কিছু সুপারিশ

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ২১৪ Time View

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মৎস্যচাষ বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনৈতিক উপ-খাতগুলোর একটি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও এর ২০১৮ সালের প্রতিবেদন) অনুযায়ী, অভ্যন্তরীন মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ দেশ। এটা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং কৃষিখাতের জিডিপিতে প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৫ দশমিক ৭২ শতাংশ) অবদান রাখছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের সামগ্রিক মৎস্য আহরণের ১৬ শতাংশই এসেছে সামুদ্রিক খাত থেকে। বাংলাদেশের ১২ শতাংশের বেশি মানুষ জীবিকার জন্য এই খাতে পূর্ণকালীন ও খন্ডকালীন ভিত্তিতে নিয়োজিত।

২০১৭-১৮ সালে মোট সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন ছিল ৬ দশমিক ৫৪ মেট্রিক টন। এ ক্ষেত্রে ২০০৮ ০৯ এর তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৭ দশমিক ২১ শতাংশ। বাংলাদেশ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিশ্বের ৫০টি দেশে মাছ, চিংড়ি ও মৎস্যজাত অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছে ৪২৮৭৬.৪০ মিলিয়ন টাকা। বাংলাদেশ এসময়ে মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪,৩১০ কোটি টাকা আয় করে।

বাংলাদেশে আমিষের চাহিদা পূরণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্যসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সমৃদ্ধ উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্রে ভরপুর বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সামনে সমুদ্র ও পানিসম্পদ কেন্দ্রিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়েছে। সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা ব্লু-গ্রোথ নামের পদক্ষেপে বিভিন্ন উপাদান রয়েছে। যেমন স্থানীয় মৎস্য সম্পদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গবেষণা, ক্ষুদ্র মৎস্য শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত করা এবং বাংলাদেশের মৎস্য শ্রমিকদের জন্য একটি গোষ্ঠী বীমা স্কিম প্রতিষ্ঠা করা।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এমন সময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে। বাংলাদেশ সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ তার সকল উন্নয়ন নীতিতে এসডিজিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। সমুদ্র ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন এগিয়ে নিতে ও সুরক্ষিত করতে বাংলাদেশ সরকার এসডিজি ১৪তে অগ্রাধিকার যুক্ত করেছে।

এসডিজি টার্গেট ১৪বিতে ক্ষুদ্র ও প্রথাগত মৎস্য শ্রমিকদের সামুদ্রিক সম্পদ ও বাজারে প্রবেশাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা সুইডিশ ইন্টারন্যশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এজেন্সী (সিডা) এর আর্থিক সহায়তায়, ড্যানিশ ইন্সটিটিউট ফর হিউম্যান রাইট্স (ডিআইএইচআর) এর তত্বাবধানে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তার সহযোগী সংগঠন বিলস ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের সাথে ২০১৮ সালের আগষ্ট মাস থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি গবেষেণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।

এই প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য খাত ভিত্তিক মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়। উক্ত প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামূদ্রিক ক্ষুদ্র মৎস্য শ্রমিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কার ও অপরাপার বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে সংলাপ, আলোচনা, লবিং ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে। সেই প্রেক্ষিতেই সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থা ও সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

ক্ষুদ্র মৎসা শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে প্রথমেই আসে তাদের জেলে কার্ডের প্রাপ্যতার বিষয়টি। জেলে কার্ড থাকলে তারা বিভিন্ন ধরণের সরকারী সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বাস্তবতা বিবেচনায় প্রকল্পের এই পর্যায়ে প্রান্তিক এইসব মৎস্য শ্রমিকদের জেলে কার্ড পাওয়া বিষয়ে প্রকল্প এলাকায় একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়।

প্রকল্পভূক্ত বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় সরকারী হিসাব অনুযায়ী ঐ এলাকার সবচেয়ে বেশি মৎস্য শ্রমিক আছে। সেই হিসেবে এই জরিপটি পরিচালিত হয় পাথরঘাটা উপজেলার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন এবং মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে । উক্ত ইউনিয়নসমূহে মৎস্য শ্রমিক আছে এমন সব পরিবারে একটি কাঠামোগত প্রশ্নমালার সাহায্যে জরিপ পরিচালনা করা হয়।

জরিপকাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন এবং কুতুবজোম ইউনিয়নে ২০ (বিশ) জন করে মোট ৪০ (চল্লিশ) জন তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পরবর্তিতে তাদের সাহায্যে ১০ (দশ) টি করে ২০ (বিশ) টি প্রশ্নমালা পরীক্ষামূলকভাবে পূরণ করার মাধ্যমে প্রশ্নমালাটি চূড়ান্ত করা হয়।

উল্লেখ্য যে, ২০১৯-২০ সালে পরিচালিত খাত ভিত্তিক গবেষণার সময় উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের মৎস্য কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনাকালে জেলে কার্ডের অপর্যাপ্ততার বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালে তারা নিজ নিজ এলাকায় জেলে তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এতে করে প্রকৃতপক্ষে জেলে না, এমন অনেকের নাম তালিকা থেকে বাদ যায় এবং প্রকৃত মৎস্য শ্রমিকের নাম সংযোজিত হয়।

এরপরেও তারা জানান যে, তালিকা হালনাগাদ করার সময় অনেক মৎস্য শ্রমিক সাগরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকায় তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা যায়নি। আবার জেলা ও উপজেলা মৎস্য অফিসের লোকবলের সংকট থাকায় তাদেরকে এই হালনাগাদ করার প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকারের বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তা নিতে হয়। এর ফলে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অনেকের নাম জেলে তালিকাভুক্ত হয়ে যায়। পাশাপাশি ব্যক্তিগত শত্রুতা ও রাজনৈতিক বিবেচনায়ও অনেক প্রকৃত মৎস্য শ্রমিকের তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশংকা থেকে যায়।

সমূদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় একটা বড় অংশের মৎস্য শ্রমিক (৪৫ শতাংশ) দিন মজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করে। এর পাশাপাশি জাল বোনা/মেরামত (১৬ শতাংশ), কৃষিকাজ (১১ শতাংশ), লুকিয়ে মাছ ধরা (৫ শতাংশ), শুটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ (২ শতাংশ), রিক্সা/অটোরিক্সা চালানো (২ শতাংশ), ক্ষুদ্র ব্যবসা (২ শতাংশ) ইত্যাদির মাধ্যমে কোনভাবে সংসারের ব্যয় মেটানোর চেষ্টা করে।

তবে ১৫ শতাংশ মৎস্য শ্রমিক জানায় যে, তারা সমূদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় কোন কাজ করেনা বা করার মত কোন কাজ পায়না। উল্লেখ্য যে, মৎস্য শ্রমিকরা বংশ পরস্পরায় মাছ ধরার কাজ করে বিধায় তাদের মধ্যে অন্য কোন কারিগরি দক্ষতা গড়ে ওঠেনি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় মূলতঃ কায়িক শ্রম নির্ভর কাজেই তারা নিয়োজিত থাকে।

গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের ৪ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ২২ দিন মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় জরিপভুক্ত মৎস্য শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ সরকারি বরাদ্দকৃত চাল পেয়েছিল। তবে, জেলে কার্ড পাওয়ার মতই সরকারি চাল পাওয়ার এই হার এলাকাভেদে ভিন্ন ছিল বলে মৎস্য শ্রমিকরা জানায়।

স্বাভাবিকভাবেই এসব বঞ্চিত মৎস্য শ্রমিক সরকারের নানা সুরক্ষা-সেবা থেকে বঞ্চিত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য টেকসই সমূদ্র প্রকল্পের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হলোঃ

১. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকৃত “জেলে” নির্ধারণের জন্য যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা,

২. দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তত্ত্বাবধানে একটি গ্রহণযোগ্য ও নির্ভুল জেলে তালিকা প্রণয়ন

৩. দুই বছর অন্তর অন্তর এই তালিকা হালনাগাদ করা

৪. প্রকৃত মৎস্য শ্রমিকদের পরিচয়পত্র প্রদান

৫. মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় প্রতিটি মৎস্য শ্রমিকের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্য সহায়তা সঠিকভাবে প্রদান নিশ্চিতকরণ

৬. খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি দৈনন্দিন নানা ব্যয় নির্বাহের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান

৭. মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে আর্থিক সংকট মোকাবিলায় মৎস্য শ্রমিকদের জন্য জরুরী ভিত্তিতে টেকসই বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা

৮. জরুরি প্রয়োজনে মৎস্য শ্রমিকদের জন্য সহজ শর্তে ও নামমাত্র সুদে ঋণের বন্দোবস্ত করা।

-এম এস আই

Please Share This Post in Your Social Media

One response to “জেলে কার্ড পাওয়া বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা ও কিছু সুপারিশ”

  1. Thank you for sharing your knowledge with us all. Your passion for your subjects shines through.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2024 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS