রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৯:০৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ

রেলওয়ে মহাপরিচালকের সীমিত ক্ষমতা ও কাঠামোগত সংস্কারে প্রধান উপদেষ্টাকে জাতীয় নীতি প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫


নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশ রেলওয়ে মহাপরিচালকের সীমিত ক্ষমতা ও কাঠামোগত সংস্কারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বরাবরে জাতীয় নীতিপ্রস্তাব পেশ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি। ২৬ মে রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির স্বাক্ষরিত এই নীতি প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ছাড়াও সিনিয়র সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়; সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়; সচিব, আইন মন্ত্রণালয়; সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়; সচিব, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রেলওয়ে বরাবরে দাখিল করা হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির দাখিলকৃত জাতীয় নীতিপ্রস্তাবটি নিম্নরূপ:

রাষ্ট্রীয় প্রবাহে রেলওয়ের প্রকৃত গুরুত্ব:
বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা নয়—এটি একটি রাষ্ট্রীয় কৌশলগত প্রতিষ্ঠান, যার শিকড় রয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক সংযোগ, দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ও জাতীয় নিরাপত্তার কেন্দ্রে। উন্নয়নশীল দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, রেলওয়ে হলো সর্বসাধারণের জীবনযাত্রার এক অনিবার্য অংশ—যেখানে পরিবহন খরচ কম, নিরাপত্তা তুলনামূলক ভালো এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পরিবহণ সম্ভব। অথচ, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নির্বাহী—মহাপরিচালক (DG)—আজ একটি প্রতীকি নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ, যার হাতে নেই বাস্তবিক ক্ষমতা, প্রশাসনিক স্বাধীনতা বা প্রকল্প বাস্তবায়নের সামর্থ্য।

এমন এক রাষ্ট্রে, যেখানে গণতন্ত্র, সুশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণ উন্নয়নের মূল ভিত্তি বলে দাবি করা হয়, সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংস্থার প্রধান নির্বাহী কেন মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় থেকে কার্যত “ক্ষমতাহীন নির্বাহী”তে পরিণত হয়েছেন, সেটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনিক ন্যায়ের প্রশ্ন তো বটেই—সংবিধানিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নও।

ইতিহাসে রেলওয়ের প্রধান নির্বাহী: দায়িত্ব ও মর্যাদার বিবর্তন:

১. ব্রিটিশ আমলে (১৮৬২-১৯৪৭):
তৎকালীন “General Manager (GM)” পদটি ছিল পূর্ণ নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন। এই পদের অধিকারী ছিলেন রেলওয়ের সমস্ত শাখা—প্রকৌশল, চলাচল, নিরাপত্তা, অর্থ ও নিয়োগ—নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাধারী। তাঁরা শুধু দপ্তরের নয়, বরং রাষ্ট্রের রেলনীতি ও অবকাঠামোগত পরিকল্পনার অংশীদার ছিলেন। প্রাইভেট কোম্পানি ও সরকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই ছিল অন্যতম কাজ। মজার বিষয়, সে সময়ও ‘রেল সচিব’ বলতে আলাদা কেউ ছিলেন না;  GM-ই ছিলেন পুরো ব্যবস্থার মুখ।

২. পাকিস্তান পর্বে (১৯৪৭-১৯৭১):
এই সময় East Pakistan Railway-এর  GM পদটি সচিব মর্যাদাসম্পন্ন হয়। তিনি সরাসরি গভর্নরের প্রশাসনিক স্তরে রিপোর্ট করতেন। বাজেট প্রণয়ন, প্রকল্প অনুমোদন, কর্মকর্তা নিয়োগ—সবই ছিল তাঁর এখতিয়ারে। যদিও সামরিক শাসন একটি কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা সৃষ্টি করে, তবুও রেলওয়ের  GM-র স্বাধীনতা ছিল পূর্ণাঙ্গ। একাধিক মন্ত্রণালয়ের অধীন না থেকে, তিনি ছিলেন স্বশাসিত রেলওয়ে ব্যুরোক্রেসির প্রধান।

৩. বাংলাদেশ পরবর্তী পর্ব (১৯৭২-বর্তমান):
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে, জাতীয়করণের ধারায় রেলওয়ের GM পদ পরিবর্তন করে “Director General (DG)” পদ চালু করা হয়। তবে এই পরিবর্তন রূপগত হলেও গুণগতভাবে এটি ছিল ক্ষমতা-হ্রাসের সূচনা। ক্রমে  DG-র অধিকার খর্ব হতে থাকে এবং তাঁকে মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ “Attached Department”-এর প্রধান হিসেবে গণ্য করা হয়। আজ DG হলেন নামমাত্র নির্বাহী, যাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত—নিয়োগ, বদলি, বাজেট, প্রকল্প—মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের উপর নির্ভরশীল।

বর্তমান বাস্তবতা: DG -এর সীমিত ক্ষমতা ও প্রতীকী নেতৃত্ব
বাংলাদেশ রেলওয়ের DG বর্তমানে এমন একটি অবস্থানে আছেন, যেখানে তিনি কোনো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তার কারণ:
১. প্রশাসনিক কর্তৃত্ব নেই
DG  নিজে নিয়োগ দিতে পারেন না, বদলি বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অনুমোদন দিতে পারেন না। তাঁকে সচিব বরাবর ফাইলে সুপারিশ করতে হয়। সচিব চাইলে সেটি বাতিল, দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলে রাখা, কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবে পরিবর্তন করতে পারেন।

২. আর্থিক ক্ষমতা সংকুচিত
একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে DG -কে পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং রেল সচিবের অনুমোদনের জন্য ফাইল চালাতে হয়। এতে করে সময়, জবাবদিহিতা এবং উদ্যোগ সবই ব্যাহত হয়।

৩. প্রতিক্রিয়া জানাতে অক্ষম
একটি বড় দুর্ঘটনার পরও DG তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে বরখাস্ত বা তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন না—তাঁকে মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

৪. কৌশলগত পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত নন
রেলওয়ের DG এখন শুধু নথি অনুমোদনের সুপারিশ করেন, নিজের উদ্যোগে কোনো জাতীয় পর্যায়ের কৌশলপত্র বা রোডম্যাপ তৈরি করতে পারেন না।

৫. রাজনৈতিক চাপের শিকার
বিভিন্ন নিয়োগ বা বদলিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রভাবশালী আমলাদের চাপ DG -এর সুপারিশকে অকার্যকর করে তোলে।

কাঠামোগত সংকট: মন্ত্রণালয়-নির্ভরতাই মূল প্রতিবন্ধকতা
রেল মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে—দুইটি সংস্থা থাকলেও কার্যত DG আজ মন্ত্রণালয়ের এক শাখা প্রধান মাত্র। অথচ আধুনিক রাষ্ট্রপরিচালনায় কার্যকর প্রশাসন মানে নির্বাহী ক্ষমতা বিভাজন এবং বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু DG -এর অধীনস্থ কর্মকর্তারা জানেন, তাঁদের ভবিষ্যত নির্ধারণ হয় DG -র দ্বারা নয়, বরং সচিব এবং তার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবধারীদের দ্বারা।

এমন বাস্তবতায় একজন মহাপরিচালক দায়িত্ব নিয়ে সাহসী উদ্যোগ নেবেন কীভাবে?

আন্তর্জাতিক উদাহরণ: ভারত, মালয়েশিয়া ও ইউরোপীয় মডেল
ভারত:
ভারতের Chairman & CEO, Railway Board পদটি একইসঙ্গে সচিব মর্যাদাসম্পন্ন। তিনি স্বাধীনভাবে বাজেট, পরিকল্পনা ও নিয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। Railway Board সরাসরি সরকারের মন্ত্রিসভার অধীন হলেও মন্ত্রণালয় নির্ভর নয়।

মালয়েশিয়া:
Keretapi Tanah Melayu Berhad (KTMB)-এর প্রধান নির্বাহী প্রতিষ্ঠানটিকে কর্পোরেট কাঠামোয় পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকলেও নির্বাহী সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বজায় থাকে।

ইউরোপ:
বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে রেল সংস্থাগুলো Regulatory Authority দ্বারা তদারক হয়, কিন্তু প্রতিদিনের প্রশাসনিক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত Executive Board গ্রহণ করে—যাদের ক্ষমতা আইন দ্বারা নির্ধারিত।

নীতিপ্রস্তাব: কাঠামোগত সংস্কারের জন্য জাতীয় পদক্ষেপ
বাংলাদেশ রেলওয়ের কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি, আর এটি করতে হবে একটি বাস্তবভিত্তিক ও ভবিষ্যতমুখী রাষ্ট্রনীতি গ্রহণের মাধ্যমে। প্রস্তাবগুলো হলো:

১. মহাপরিচালকের পদে সচিব মর্যাদা প্রদান
DG পদকে সচিব পদমর্যাদা দিয়ে একটি স্বশাসিত রেল প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। তিনি যেন নিয়োগ, বাজেট এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বাধীনতা পান।

২. রেলওয়ে বোর্ড গঠন
একটি Railway Executive Board গঠন করতে হবে, যেখানে মহাপরিচালক, প্রকৌশল, চলাচল, অর্থ, নিরাপত্তা ও আইনের শীর্ষ কর্মকর্তা থাকবেন। এই বোর্ড মাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবে।

৩. স্বাধীন অর্থায়ন কাঠামো
বার্ষিক বাজেট প্রণয়নে রেল DG-কে স্বাধীনতা দিতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি সমন্বয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতা DG-এর হাতে
শ্রেণিভিত্তিক কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থা গ্রহণে DG-এর পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। সচিব বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সীমিত করতে হবে।

৫. আইন প্রণয়ন
“বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা আইন, ২০২৫” নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে DG-এর দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংজ্ঞায়িত থাকবে।

সংবিধান ও আইনের আলোকে DG-এর অবস্থান
বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী:
* অনুচ্ছেদ ৭ ও ২১: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মালিক জনগণ; প্রশাসনের দায়িত্ব জনস্বার্থে কাজ করা।
* অনুচ্ছেদ ৫৫ (৩): কার্যনির্বাহী বিভাগে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং কর্মকর্তাদের কার্যকরী দায়িত্বে রাখা।
* অনুচ্ছেদ ৫৯: স্থানীয় প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ও কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রদান।

DG যদি প্রকৃত প্রশাসনিক প্রধান হন, তবে উপরোক্ত সংবিধানিক বিধান অনুসারে তাঁর হাতে থাকাই উচিত-
* নিয়োগ ও বদলি ক্ষমতা
* আর্থিক বরাদ্দ ও প্রকল্প গ্রহণের ক্ষমতা
* শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা

কিন্তু বাস্তবে, তিনি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ব্যতীত কিছুই করতে পারেন না। এটি সংবিধানের প্রতিও পরোক্ষভাবে অবমাননা। আজ উএ পদটি কার্যত “A General Without Command”- নির্দেশ পালনের যন্ত্র মাত্র, যার হাতে নেই বাস্তব কর্তৃত্ব।

সময় এখন বিকেন্দ্রীকরণের:
বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি শতাব্দীপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান, যার উপর কোটি কোটি মানুষের যাতায়াত ও জীবিকা নির্ভর করে। অথচ এর প্রধান নির্বাহী আজ “ক্ষমতাহীন” এবং “সুপারিশদাতা” মাত্র। এটি কেবল একটি দুঃখজনক বাস্তবতা নয়—রাষ্ট্রীয় অবহেলার প্রতিচ্ছবি।

আজ প্রয়োজন একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত—রেলওয়েকে মন্ত্রণালয়ের “দাসত্ব” থেকে মুক্ত করে একটি আধুনিক, কার্যকর, স্বাধীন প্রশাসনিক কাঠামোয় রূপান্তরিত করা। মহাপরিচালককে পূর্ণ ক্ষমতা দিলে শুধুই একটি পদ নয়, গোটা সংস্থাটি সচল হবে। সুশাসন, জবাবদিহিতা ও জনসেবায় রেলওয়ে একটি গর্বের মডেল হয়ে উঠতে পারে।

বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে উপরোক্ত প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS