সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ০১:৪৩ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ

আইনানুগ, সংবিধানসম্মত ও নৈতিক যুক্তিনির্ভর পোষ্য কোটা সংরক্ষণে রেল সচিব ও ডিজি’র কাছে পোষ্য সোসাইটির আবেদন

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫


নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আইনানুগ, সংবিধানসম্মত ও নৈতিক যুক্তিনির্ভর রেলওয়ে পোষ্য কোটা সংরক্ষণে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের আবেদন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি। রেল ভবনে রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির স্বাক্ষরিত এ আবেদনপত্র দাখিল করা হয়।

আবেদনপত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, রেলওয়ের পোষ্য কোটার ইতিহাস, অধিকার ও ন্যায়ের অনিবার্যতা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা না করে রেলওয়ে কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ২০২০ সংশোধন কমিটি সংশোধিত খসড়া বিধিমালায় রেলওয়ে পোষ্যদের জন্য সংরক্ষিত কোটা বিলুপ্তির প্রস্তাব পাঠিয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে প্রচারিত হচ্ছে। আমরা মনে করি, ৭৫ বছরের পুরনো মানবিক ও সাংবিধানিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পোষ্য কোটা বাতিল নয়, বরং সংরক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সময়ের দাবি।

১. বাংলাদেশ রেলওয়ে কেবল একটি রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা নয়; এটি একটি প্রজন্মান্তরের কর্মজীবন, আত্মত্যাগ এবং সম্মানজনক জীবিকা-নির্ভর ঐতিহাসিক একটি বিশেষায়িত কারিগরি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পরিবার, বিশেষ করে সন্তান ও নির্ভরশীলদের জন্য ‘পোষ্য কোটা’ কেবল একটি প্রশাসনিক শর্ত নয়—এটি এক মানবিক, আইনানুগ এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি। এই অধিকার রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক সামাজিক সুরক্ষা নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং এটি রেলওয়ের সামাজিক দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।

২. ঐতিহাসিক পটভূমি: ১৯৪৭-১৯৬০
Substituted Recruitment নামক একটি প্রথা ব্রিটিশ আমলে চালু ছিল। এর আওতায়, অবসর বা মৃত্যুবরণকারী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির রেলকর্মচারীর সন্তান/পোষ্যকে খালি পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হতো। এই নিয়োগ ছিল “test-free compassionate appointment”—যেখানে কর্মীর আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে পরিবারের একজনকে নিয়োগ দেওয়া হতো।
Railway Establishment Code, ১৯৪৭ অনুচ্ছেদ ২৮(গ): “…স্থায়ী কর্মচারীর অবসর বা মৃত্যুর পরে তাঁর একমাত্র উপযুক্ত পুত্র/কন্যাকে সরাসরি নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।”

৩. আইনানুগ রূপান্তর: ১৯৬১-১৯৮৫
Railway Establishment Code & Recruitment Rules, 1961, ধারা ৩৫(গ)-এ প্রথমবারের মতো ২০% কোটা সংরক্ষণ করা হয়: “Class III & IV শূন্যপদের ২০ শতাংশ সংরক্ষিত থাকবে সেইসব স্থায়ী রেল কর্মচারীর সন্তানদের জন্য, যারা অন্তত ১৫ বছরের চাকরি সম্পন্ন করেছেন।”
১৯৮৫ সালে, Bangladesh Railway Non-Gazetted Service Recruitment Rules, 1985-এর মাধ্যমে এই কোটা ২০% থেকে বাড়িয়ে ৪০% করা হয় (ধারা 4(e)(ii)):
“…40 percent of all vacancies will be reserved for sons/daughters and dependent brothers/sisters of permanent railway employees (with minimum 15 years service), and of retired railway employees dead or alive.”

৪. আধুনিকীকরণ: ২০২০ ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া
Bangladesh Railway Non-Cadre Recruitment Rules, 2020-এ কোটা বহাল রাখা হয় এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতে অনলাইন আবেদন ও ট্র্যাকিং ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এই বিধিমালা এখনো আইনি ভিত্তিতে সক্রিয় এবং কার্যকর—তবে বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতা ও ভুল ব্যাখ্যা ঘটছে।

৫. সংবিধানিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশ সংবিধান এই ধরনের সামাজিক সুরক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে:
* অনুচ্ছেদ ২৭: আইনের চোখে সমতা
* অনুচ্ছেদ ২৮(৪): অনগ্রসর শ্রেণির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ
* অনুচ্ছেদ ২৯(৩): সরকারি নিয়োগে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান
* অনুচ্ছেদ ১৫: “…right to work, to reasonable wages, and to social security…”
এসব অনুচ্ছেদের আলোকে, পোষ্য কোটা affirmative action বা ইতিবাচক বৈষম্যের একটি সাংবিধানিক অনুশীলন।

৬. আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত ও ন্যায্যতা
ILO Convention No. 102 (Social Security Minimum Standards):
“Governments shall uphold institutional support for dependent families of public servants, especially in transportation and defense sectors.”
(সরকারসমূহকে পরিবহন ও প্রতিরক্ষা খাতে কর্মরত সরকারি কর্মচারীদের নির্ভরশীল পরিবারগুলোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।)

প্রতিবেশী দেশসমূহ:
* ভারত: Indian Railways -এ এখনো “Compassionate Ground Appointment” চালু রয়েছে
* পাকিস্তান: Railway Dependent Quota বলবৎ রয়েছে
* দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স: রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় পরিবারভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে
বাংলাদেশ যদি SDG Goal 8 (Decent Work and Economic Growth) অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তাহলে পোষ্য কোটার মতো মানবিক নীতি অবশ্যই বহাল রাখতে হবে।

৭. বর্তমানে চ্যালেঞ্জ ও বিভ্রান্তি
* নিয়োগ সার্কুলারে ‘পোষ্য কোটা’ উল্লেখ না থাকা
* সংশোধন কমিটির অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব
* সচেতনভাবে বিলম্ব এবং জবাবদিহিতার অভাব
“নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান বিধি ও পরবর্তীতে কোনো সংশোধন হলে তা অনুসরণ করতে হবে”—এই ভাষা ব্যবহার করে বর্তমান বৈধ বিধিমালাকে পাশ কাটানো হচ্ছে, যা বেআইনি এবং উদ্দেশ্যপ্রসূত। কোনো প্রশাসনিক পরিপত্র বা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আইনি বিধিমালার অংশবিশেষ বাতিল করা আইন ও সংবিধান বিরোধী।

৮. প্রস্তাবনা ও করণীয়
১. রেলওয়ের পোষ্য কোটা (৪০%) সংরক্ষণের বিষয়টি গেজেট প্রকাশ করে পুনরায় নিশ্চিত করা হোক
২. প্রতিটি নিয়োগে কোটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিতে ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা হোক
৩. মেধার সঙ্গে মানবিকতা সমন্বয় করে যোগ্য পোষ্যদের প্রশিক্ষণমূলক ও ওরিয়েন্টেশন কোর্স দেওয়া হোক
৪. পোষ্য কোটা সম্পর্কিত আইনি সহায়তা ইউনিট (Legal Aid Cell) গঠন করে অভিযোগ নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করা হোক
৫. SDG ও ILO–এর আলোকে আন্তর্জাতিক রেফারেন্স সম্বলিত সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করা হোক

৯. রেলওয়ের পোষ্য কোটা কোনো অনুগ্রহ নয়—এটি একটি আইনত স্বীকৃত, মানবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত অধিকার। এটি বাতিল করা মানে:
* ইতিহাস অস্বীকার করা
* আত্মত্যাগের অবমূল্যায়ন
* সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া
“রেল চলে কর্মচারীর ঘাম-রক্তে, আর কর্মচারীর পরিবার চলে একটি ন্যায্য আশ্বাসে—সেই আশ্বাসের নামই পোষ্য কোটা।”

১০. অতিরিক্ত আইনি, নীতিগত ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যা
Legitimate Expectation এবং প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত একাধিক রায়ে Legitimate Expectation তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নাগরিকগণ যদি দীর্ঘদিন ধরে কোনো সুবিধা ভোগ করে থাকেন, তবে প্রশাসন তা হঠাৎ করে যুক্তিহীনভাবে বাতিল করতে পারে না।
মামলা: Secretary, Ministry of Finance v. Md. Masud Hossain & others (2012)
“When a benefit has been enjoyed continuously under an established policy, any abrupt withdrawal of that benefit without rationale offends the principle of fairness.”

নীতিনির্ধারণে স্বেচ্ছাচারিতা নিষিদ্ধ
প্রশাসন যদি যুক্তিহীনভাবে বা পক্ষপাতমূলকভাবে কোনো নীতি বাতিল করে, তা Rule of Law, Administrative Fairness এবং সংবিধান পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।

সংবিধান লঙ্ঘনের দৃষ্টিকোণ থেকে
* ২৭ অনুচ্ছেদ: আইনের সমতা লঙ্ঘন
* ২৯(৩) অনুচ্ছেদ: পেছিয়ে পড়া অংশের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অস্বীকার
* ১৫ অনুচ্ছেদ: কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার মৌলিক অধিকার থেকে সরে আসা

১১. চূড়ান্ত দাবি
বাংলাদেশ রেলওয়ের পোষ্য কোটা বাতিলের যেকোনো প্রচেষ্টা বেআইনি, অসাংবিধানিক ও অমানবিক। আমাদের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ দাবি: পোষ্য কোটা সংরক্ষণ ও কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করুন—এটি ইতিহাস, আইন, নীতি ও ন্যায়ের দাবি।

আবেদনপত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ের পোষ্য কোটা সংরক্ষণের বিষয়টি আইনানুগ, সংবিধানসম্মত ও নৈতিক যুক্তিনির্ভর হওয়ায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে রেলপথ সচিব ও রেলওয়ে মহাপরিচালককে অনুরোধ জানানো হয়।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS