বগুড়া থেকেঃ সময়ের পরিক্রমায় স্মার্ট ফোনের আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো থেকে আয়ের একটা বড় অংশ ব্যক্তিগত ব্লগ ভিডিও। যেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক থেকে শুরু করে শিশুদেরও উপস্থিতি জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
ইসমাত আরা রিমি (ছদ্মনাম)। বয়স পাঁচ কি ছয়! বেশ সুন্দর করে পাকা পাকা কথা বলা সংলাপ আর নাচের ভাইরাল ভিডিও ঘুরছে ফেইসবুকে। পেইজটির মালিক রিনা নামের এক গৃহিণী। ছোট্ট শিশুর হিন্দি সিনেমার বিনোদনমত্ত নাচ নিয়ে দর্শকের বাহবা কমেন্টবক্সে।
বারো বছর বয়সী মাইশার টিকটকে এক মিলিয়ন লাইক মাইলফলক স্পর্শ করায় পরিবারের সবাই মিলে কেক কেটে উদ্যাপন করছে। আইডি মেনশন করে অভিনন্দন জানাচ্ছে নিকট আত্মীয় ও বন্ধুরা। উদ্যাপনের এক পর্যায়ে মা ও ভাইকে উপহার দিতে দেখা গেলো হাজার টাকার নতুন সরঞ্জাম। যা দিয়ে তৈরি হবে উচ্চ রেজুলেশনের আরো সুন্দর ভিডিও!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বড়দের সঙ্গে একপ্রকার পাল্লা দিয়েই বাড়ছে শিশু-কিশোরদের মধ্যে তারকা হওয়ার প্রবণতা। শিশুদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের উপস্থিতির বিষয়টি তাদের পরিবারের অজানা নয়; বরং মা-বাবা কিংবা পরিবারের বড়দের ছত্রছায়ায় তারকা হওয়ার এই অস্বাস্থ্যকর দৌড়ে নেমে পড়েছে। অস্পষ্ট-আধো বুলিতে সদ্য কথা বলতে পারা শিশুটিকে দিয়ে পরিবারের বড় ভাই, বোন কিংবা মা বানাচ্ছেন ভিডিও! শিশুদের দিয়ে এমনভাবে কথাবার্তা বলানো হচ্ছে, রিল’স বানানো হচ্ছে, টিকটক করানো হচ্ছে, যা দেখেশুনে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় নাই। দায়িত্বজ্ঞানহীন এ ধরনের উপস্থিতির দায় কি শিশুর একার?
সোশাল মিডিয়ার বাণিজ্যিকীকরণ প্রক্রিয়াটি তারকা হওয়ার এ যুদ্ধকে যেন আরো চূড়ান্ত রূপ দিয়েছে মায়েদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায়! মায়েদের চোখে ক্যামেরার সামনে বাচ্চার চতুর উপস্থিতি আর পাকা পাকা কথার বিচারেই যাচাই করা হচ্ছে শিশুদের মেধা। শিশুদের দিয়ে বানানো এসব ভিডিও কন্টেন্ট মজার ছলে লাইক-শেয়ার করছেন অনেকে। ফলে শিশুদের পণ্য বানিয়ে তথাকথিত ভিউ আর ইনকামের নেশায় আরও বেশি ভিডিও তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে অভিভাবকের একাংশ।
এসব মাধ্যমে রাতারাতি সস্তা জনপ্রিয় হওয়ার আগপর্যন্ত মানুষের প্রতিভা প্রদর্শনের মাধ্যম ছিল ছিল পত্রপত্রিকা, বইপুস্তক, রেডিও ও টেলিভিশন। এছাড়া থিয়েটার কিংবা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মঞ্চ। এসব মাধ্যমে সুযোগ পেতে হলে যোগ্য হয়ে উঠতে হতো। প্রয়োজন হতো সাধনা, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও পূর্বপ্রস্তুতির। কিন্তু এখন ফলোয়ার, ভিউ কিংবা সাবস্ক্রিপশন দিয়ে নির্ধারিত হয় তারকার জনপ্রিয়তা ও বাজারমূল্য। বর্তমানে জনপ্রিয় হওয়ার এই মাধ্যম বিনোদনের ধারণা পাল্টে গেছে। ‘জনপ্রিয়’ শব্দটির সংজ্ঞাতেও বোধ হয় এসেছে পরিবর্তন!
ছবি: ইউটিউব, ফেসবুক ও টিকটকের জন্য ভিডিও তৈরি করছে শিশু-কিশোররা।
ইমরান আহসান নামের এক আইডি থেকে নিয়মিত সাত থেকে নয় বছর বয়সী দুই শিশুর ভিডিও আসে টিকটকে। শিশু মুখে প্রেমের সংলাপ! খেলনা অস্ত্র হাতে খলনায়ক, হাতে সিগারেট নিয়ে মাস্তানসহ নানা চরিত্রে অভিনয়ের ভিডিও দেখা যায়। প্রতিটি ভিডিওর ভিউ লাখের ঘরে।
এসব দেখে রীতিমতো ভাবতে বাধ্য করছে এতো এতো অসুস্থ বিনোদনের কারণ একটাই- স্বল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, শিশুর প্রতিভার বিকাশ নয়। একটি চমৎকার ও আনন্দময় শৈশব শিশুর অধিকার যা এক প্রকার মানবাধিকারও বটে।
নিজের পাঁচ বছর বয়সী শিশু মুহিবকে নিয়ে বিভিন্ন ভিডিও তৈরি করে এখন পঞ্চাশ হাজার ফলোয়ারের পেইজ বগুড়ায় মিম নামের এক তরুণীর। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে শিশুর মেধা বিকশিত হচ্ছে। শিশুর কথা বলা আরো স্পষ্ট হচ্ছে। সময় কাটছে। আমার সন্তানও বিষয়টা উপভোগ করে। কান্নাকাটি করে না। আমি আমার সন্তানকে অভিনেতা বানাতে চাই। আমাদের টিকটক ও ইউটিউবেও ভিডিও ছাড়া হয়।’
বগুড়ায় শিশুদের নিয়ে কাজ করা বাতায়নের স্বত্বাধিকারী বিকে সরকার লালন বলেন, ‘শিশুর ভবিষ্যতের জন্য আনন্দময় শৈশব অত্যন্ত জরুরি। আর এ দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি বর্তায় মা-বাবার ওপর। কয়েক বছর আগেও মায়েরা শিশুদের নতুন নতুন শব্দ শেখানোর পাশাপাশি ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। আগে বলা হতো শিশুর বয়স হলে ছয়, ভর্তি কর বিদ্যালয়। আর এখন সেটা অনেকটা এমন যে, বাচ্চা যখন কথা বলে, তাকে নিয়ে ভিডিও ছাড়! ’
বর্তমান সময়ে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের মূল্যবান সময়গুলো চলে যাচ্ছে ক্যামেরার সামনে তোতাপাখির মতো পাকা পাকা বুলি আওড়াতেই। ঘরের মধ্যে একপ্রকার শুটিং স্পট তৈরি করে মন মতো করা হচ্ছে শুটিং! একটু এদিক সেদিক হলেই বারবার করানো হচ্ছে একই কাজ। মাঝেমধ্যে বিরক্তের ছাপ দেখিয়ে বোকাবোকি করা হচ্ছে শিশুটিকে!
ফেইসবুক, ইউটিউব, টিকটকে যাদের ফ্যান-ফলোয়ার বেশি, তাদের ভিডিও করার আগ্রহ তৈরি বেশি। কেননা এতে রাতারাতি নিজেকে প্রচার করা যায়। প্রতিদিন ভিডিও আপলোড করতে হবে এই চাপে ভিডিও তৈরি আর পড়াশোনা ছাড়া অন্য কাজ বা বাহিরে বের হতে দেয়া হচ্ছে না সন্তানকে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে বিপুলসংখ্যক সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অবস্থান ধরে রাখার চাপ সামলাতে বিষণ্নতায় ভুগছেন। বড়রাই যেখানে জনপ্রিয়তার এই চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে শিশুদের জন্য এই ধরনের মানসিক চাপ ডেকে আনতে পারে ভয়ংকর পরিণতি।
শিশুর বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে পরিবার। পরিবার কি পারে না জনপ্রিয় হওয়ার এ ধরনের অহেতুক চাপ থেকে শিশুদের মুক্তি দিতে এবং তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে?
উদ্বেগের বিষয় শিশুদের নিয়ে বানানো ব্লগ ভিডিওর জন্য খেলার মাঠের চেয়ে ফোন স্ক্রিনেই তার শৈশব আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে এবং পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার আগেই মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে শিশুটি সাইবার অপরাধের শিকার হতে পারে, বাড়তে পারে ঝুঁকি।
ছবি: ইউটিউবে একজন অভিভাবক ৪ বছর বয়সী শিশুদের ফাইটিং ভিডিওটি শেয়ার করেছেন। যেখানে একজন শিশু অন্য শিশুকে আঘাত করার চেষ্টা করছে।
অপরিণত বয়সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় তারকাখ্যাতি শিশুকে অসহিষ্ণু ও অন্যের প্রতি অসংবেদনশীল করে তুলতে পারে। শিশুটি নিজেকে অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শিখে কিংবা অন্যের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলে। ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব পুষতে থাকে। তারকা হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয় শিশুমন।
একই সঙ্গে যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এত এত জাঁকজমকপূর্ণ, চোখ ঝাঁঝানো লাইফস্টাইল দেখে শিশুদের মধ্যেও তেমন জীবনধারণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে নানাবিধ কাজে জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা। অভিভাবকদের সাথে জোরপূর্বক তা হাসিলের চেষ্টা চালাতে থাকছে। ফলে হিতের বিপরীতে চলছে শৈশব কৈশোর!
এসব কন্টেন্ট দেখে অন্য শিশুরা ভাবছে, ওই শিশুটির মতো তারও খ্যাতি দরকার, টাকা দরকার। এর জন্য পরিবারের উপর ফোন কেনার চাপ দিচ্ছে শিশু কিশোররা। ফোন হাতে পেয়েই চলছে কন্টেন্টের নামে যাচ্ছেতাই অবস্থা! এখানে নিজের উচ্চতা প্রমাণে ফ্যান-ফলোয়ারের (অনুসারী) সংখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। তাই এসব নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা, কখনো অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তৈরি হয় গ্রুপিং, গ্রুপিং থেকে গ্যাং বা কিশোর গ্যাং। বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে শুরু হয় হানাহানি, কাদা ছোড়াছুড়ি– সংঘাত। পত্রিকায় দেখা যায়, টিকটক করতে দ্বন্দ্ব, মারামারি! ভিডিওতে হাহা রিয়্যাক্ট, বন্ধু আহত! ভিডিও বানানোর নাম করে কিশোরী ধর্ষণ, পাচার সহ নানান ঘটনা।
জাগো নিউজের খবর বলছে, ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত গ্রামের ছয় বছরের সামিউল (ছদ্মনাম)।হঠাৎ তার কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। ভিডিওতে শিশু সামিউলের মুখে প্রেমের উক্তি ও অযাচিত সব মন্তব্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যঙ্গ করে উপস্থাপিত হয় শিশু সামিউল। তাকে দিয়ে এসব ভিডিও বানাতো তার বড় ভাই। সে নিজেও একজন কিশোর। অর্থাৎ নিজেদের অজান্তেই শিশু-কিশোর বয়সী এ দুই ভাইয়ের ডিজিটাল দুনিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বিচরণ।
ছবি: শিশুদের জন্য অনুপযোগী টাইটেল ব্যবহার করে মাত্র ২ দিনে ২.৫ মিলিয়ন ভিউয়ের সঙ্গে কমেন্ট শেয়ার। ছবিটি ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত।
তারকা খ্যাতি পাওয়া শিশু লুবাবা একটি সিনেমা দেখে ‘কেন্দে দিছি’ বলে মন্তব্য করায়- কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাগাতার কটাক্ষের শিকার হয়। এতে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তার মা জাহিদা ইসলাম আইনি পদক্ষেপ নিতে ডিবি কার্যালয়ে শরণাপন্ন হন।
এর আগে মাদ্রাসা ছাত্র রিফাত –জাতীয় মাছ পাঙাশ বলে ভাইরাল হয়। রীতিমতো তার কাছে সাক্ষাৎকার নিতে উপচে পড়ে ইউটিউবারা। অথচ পাঁচ বছর বয়সী ওই শিশুর জন্য এত ক্যামেরা আর এক সংলাপ বারবার বলা ও ইউটিউবারদের তীর্যক প্রশ্নে যেমন বিরক্ত, তেমনিই ছিল অস্বস্থিরও। ব্যাহত হয় পড়াশোনাও!
লুবাবা, সামিউল আর রিফাত উদাহরণ মাত্র। তাদের মতো হাজারো শিশুকে নিয়ে ট্রোল বুলিং আর কটাক্ষের প্রবণতা বেড়েছে কয়েকগুণ।
একটা ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা মানে সেটা অনেকটা ‘পাবলিক প্রোপার্টি’। যে কেউ যেকোনোভাবে ছবিটি ব্যবহার করতে চাইলে আপনি সেটা থামাতে পারবেন না। ডিপ ফেইক প্রযুক্তিতে যেকোনো মানুষের ছবি ব্যবহার করে আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া এখন খুব সহজ হয়ে গেছে।
ছবি: একজন মা তার সন্তানকে নিয়ে ভিডিও তৈরি করছেন এবং সন্তানকে বারবার ক্যামেরার সামনে কথা বলতে জোরাজোরি করছেন। বারবার দোকানে গিয়ে শিশুর অনুভূতি কি তা জানানোর চেষ্টা করছিলেন।
এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢালাওভাবে শিশুদের ছবি, ভিডিও ও তথ্য শেয়ার করলে এর বিরূপ প্রভাব শিশুটির বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপর পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে পৃথক দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ শিশু একটি সাইবার অপরাধের শিকার। ৩৮ ও ২৬ শতাংশ যথাক্রমে দুটি ও তিনটি সাইবার অপরাধের শিকার।
ইলহাম ফাবিয়া নামের এক স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের যাদের জন্ম আশি-নব্বই দশক পূর্ববতী সময়ের যারা; তাদের শৈশব সুন্দর ও স্মৃতিময়! বর্তমানে ফেসবুক টিকটকে যা দেখছি, মনে হচ্ছে না আমাদের ফলাফল কতটা সুখকর হবে। সঙ্গে তো মায়ের ডিজিটাল হবার প্রবণতা ভাবাচ্ছে। আধুনিকতার এই যুগে তারকা হবার দৌড়ে অভিভাবকরা যেভাবে তাদের সন্তানকে কুক্ষিগত করে রেখে একের পর এক গল্প সাজিয়ে দর্শক মহলে জানান দিচ্ছে। শিশুদের শৈশব বলে কি কিছু থাকছে? ভালো রেজাল্ট আর অনলাইনে তারকা এই দুই তকমা লাগানোর জন্য প্রতিটি অভিভাবকই এখন হন্যে প্রায়।’
হামিদুর রহমান নামের আরেক অভিভাবক বলেন, ‘যে বয়সে জানার কথা ছিল রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশ, চর্চা করার কথা বিভিন্ন সৃজনশীল অভ্যাস, ঠিক তখন আগামী প্রজন্ম ঠিক কোন পথ বেছে নিচ্ছে নিজেদের জন্য, তা বোধগম্য হয় না। টিকটক, লাইকি ব্যবহারকারী অনেকেই দাবি করেন, এর মাধ্যমে তাদের অভিনয় মেধা বিকশিত হবে। তাহলে তারা কি দাবি করতে চান মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠিতদের অভিনয় গুরু এসব অ্যাপস? কই এত এত বড় যারা সেলিব্রিটি আছে। তারা তো ছোট থেকেই এরকম প্রতিযোগিতায় নামে নি। দু-একজন ছাড়া! এখন কি নীরব প্রজন্মের শৈশব সংকটের সময়ে আমরা?
সেলিব্রিটিজম শেখাচ্ছে– শোভন বা অশোভন; বিখ্যাত হওয়াই আসল কথা। বিখ্যাত হলে টাকা আসবে; ভিডিওর ভিউ লাখ ছাড়ালেও টাকা। শিশুদের একাধারে ‘খুদে প্রাপ্তবয়স্ক’ বানানো হয়, অন্যদিকে তারা হয় বড়দের ‘আনন্দের খোরাক’।
আরব দেশে এক সময় অনারব শিশুদের উটের দৌড়ের জকি করা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে, দুনিয়াজুড়ে বিনোদনের জকি করা হচ্ছে শিশু-কিশোরীদের। টেলিভিশন, ফেসবুক রিল’স, ইউটিউব ও টিকটকে শিশু-কিশোরীরা বিনোদনের জকির ভূমিকায় নেমে পড়ছে। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। রাষ্ট্রের পতন হয় নাকি সশব্দে; কিন্তু নীতি-নৈতিকতার মৃত্যু ঘটে তো নীরবে -নিভৃতে, নিঃশব্দে!
শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া মানসিক-দূষণ কেন সইতে হবে? গল্পের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা জাদুর বাঁশি বাজিয়ে শিশুদের চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। আর আজ শিশুদের শৈশবের কোমলতা চুরি হচ্ছে বড়দের ব্লগ ভিডিওর বেড়াজালে। শিশুদের বড় করে দিলে চলবে না; বড় হতে দিতে হবে।
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের আইসিটি বিভাগের প্রধান হেফজুর রহমান বলেন, ‘ভার্চুয়াল দুনিয়ায় শিশু কিশোরদের ঝুঁকিপূর্ণ বিচরণ নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। এটা বলার অবকাশ রাখে না। তবে আমি মনে করি, সময়টা যতোই প্রযুক্তির হোক – তা কিন্তু শিশুদের জন্য এক প্রকার মানসিক দূষণ। প্রযুক্তি তো এগোচ্ছে তবে তা শিশুদের জন্য অনুপযোগী। সুতরাং অভিভাবকদের সচেতনতার বিকল্প আপাতত কিছু দেখছি না।’
ইউনিসেফের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে উদ্যাপিত বিশ্ব শিশু দিবসে এক সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শিশুরা তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার হবে এবং তাদের অধিকারের সমর্থনে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। কারণ, আজও প্রতিটি শিশু তাদের পূর্ণ শৈশব উপভোগ করতে পারে না। অনেকের শৈশবই ক্ষণস্থায়ী।’
শুধুই কি ছিন্নমূল শিশু, হিজড়া শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, এতিম শিশুরই শৈশব কি ঝুঁকিপূর্ণ বা শৈশব উপভোগ করতে পারে না? উত্তর হলো- এর বাহিরেও সচেতন ঘরে বেড়ে ওঠা শিশুটিরও শৈশব প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে স্পষ্ট বাধা খোদ পরিবারের সদস্যরা। যারা তাদের তারকা বানাতে রীতিমতো যুদ্ধে নেমে গিয়েছে! যার ফলে প্রযুক্তির কাছে শৈশবকে রেখেছে বন্ধকে। আলোর নিচে অন্ধকার আর নিষ্ঠুরতার কথা সমাজ কি জানে না?
সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন শিশু তাদের শৈশবকে হারিয়ে ফেলেছে কোনো না কোনোভাবে।
শিশু ও কিশোরদের শৈশবকালীন অবস্থা বিবেচনায় ১৭২টি দেশের উপর জরিপের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শিশু-সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন `স্টোলেন চাইল্ডহুড বা চুরি হয়ে যাওয়া শৈশব` শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। গবেষণায় সুপারিশে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সব শিশুই স্থানকাল নির্বিশেষে নিরাপদে থাকবে এবং শিশুদের শৈশব রক্ষার জন্য বিনিয়োগ বরাদ্দ নিশ্চিত করবে।
শৈশবে আমি চিড়িয়াখানা দেখিনি, শিশুপার্ক দেখিনি, জাদুঘর দেখিনি, নদী দেখিনি, সমুদ্র দেখিনি, পাহাড় দেখিনি, দেখিনি কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনা কিংবা নিদর্শন। পরিবারের কেউই আমাকে এসব দেখানোর সময় ও সুযোগ করে উঠতে পারেনি। তীরে আমি দাঁড়াইনি, পিপাসার্ত মানুষের কোনো কাজেই না লাগা সমুদ্রের লবণাক্ত জল আমাকে স্পর্শ করেনি। হয়ত দিন শেষে এসব অভিযোগে পরিপূর্ণ হবে আগামীর প্রজন্মের শৈশব কৈশরের স্মৃতি! দায়ী করা হবে বাবা-মা কিংবা পরিবারের সদস্যদের।
কিছুই কি করার নাই? একদিকে যেমন শিশুদের অবরোধবাসিনী করে তোলা হচ্ছে, আরেকদিকে তেমনি বিনোদনের চরম পিচ্ছিল পথে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে – আর এই দুই বিপরীতের টানাপোড়েনে কত জীবন, কত শৈশব-কৈশোর যে নষ্ট হচ্ছে, তার খবর কি রাখছি আমরা?
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply