শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৯:৩৬ পূর্বাহ্ন

রাজস্ব ঘাটতি কমাতে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : রবিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২৫

নানা কারণে গেল বছর নিত্যপণ্যের বাজার ছিল রীতিমতো ‘পাগলা ঘোড়া’। দামের চোটে বছরজুড়ে গড় মূল্যস্ফীতি থেকেছে দুই অঙ্কের ঘরে। খরচা ছুটলেও মানুষের রোজগার বাড়েনি তেমন। উল্টো চাকরি খুইয়ে ধুঁকছেন অনেকে। এর মধ্যেই দুঃসংবাদ হয়ে হাজির শতাধিক পণ্য ও সেবায় নতুন শুল্ক-কর। এতে নাটাই যেভাবে ছুটবে, তাতে জীবনযাত্রা খরচার সামাল দেওয়া অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে নির্ধারিত আয়ের মানুষের। গেল আগস্টে দেশের রাজনৈতিকে মঞ্চ বদলের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তাও ফিকে হয়ে আসছে।

গত বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নতুন হার ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ফল, মুঠোফোন সেবা, ইন্টারনেট, টিস্যু, রান্নার গ্যাস, পোশাক, রেস্তোরাঁয় খাবার ইত্যাদি এখন জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ। নতুন করে শুল্ক–কর বৃদ্ধি মধ্যম ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়াবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্ক-করের পরিমাণ না বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানো উচিত। বিভিন্ন খাতে অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যারা ভ্যাট দিচ্ছেন না। কর হার কমিয়ে এসব ব্যবসায়ীকে ভ্যাটের আওতায় আনা গেলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। তবে সরকার সে পথে না হেঁটে যারা নিয়মিত ভ্যাট দিচ্ছেন, তাদের ওপরেই আরও বোঝা চাপাল। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যে। বাড়বে কর ফাঁকির প্রবণতাও। তারা মনে করেন, সরকারের উচিত, প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবায় ভ্যাট অব্যাহতি বা কমানো, ভ্যাট ব্যবস্থা সহজ করা। পাশাপাশি ভ্যাট কমিয়ে করের আওতা বাড়ানো।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুল্ক–কর বাড়ানোর কারণে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করা যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি কমবে।

সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও এনবিআর দাবি করেছে, এতে ভোক্তার বাড়তি মূল্য গুনতে হবে না।

শুল্ক-কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা দাবি করেছেন, এই পদক্ষেপে নিত্যপণ্যের বাজারে ‘প্রভাব পড়বে না’। কর আদায়কারী সংস্থা এনবিআরও একই সুরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দাবি করে জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতিতে ‘প্রভাব পড়বে না’। 

তবে, এই বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, যেসব পণ্যে ট্যাক্স বেড়েছে, সেগুলোর দাম তো বাড়বে। কোনো ধরনের বাস্তবতায় এটা (প্রভাব পড়বে না) তো হয় না। প্রভাব পড়বে না বলা হলে, বোধ হয় তা বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়।

জাহিদ হোসেন বলেন, ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) অনুযায়ী, এসব পণ্যের ওজন কম, দর কম, সেজন্য হয়ত মূল্যস্ফীতির হারের উপর খুবই কম প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হল, অধিকাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে যেগুলো ১৫ শতাংশের নিচে ছিল, সেগুলোকে ১৫ শতাংশে উঠানো হয়েছে। তার মানে ভ্যাট রেইট ইউনিফিকেশন (একীভূতকরণ), মানে সব পণ্যে একই ভ্যাট হবে, এটা তো একটা নীতি ছিল সরকারের। এর মধ্যে অনেক অব্যাহতি ছিল। ওই অব্যাহতিগুলোকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। কারণ, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। রাজস্বে তো এখন পর্যন্ত কোনো প্রবৃদ্ধি নেই।

শুল্ক ও কর বাড়ানোর জন্য এই সময়টাকে যথোপযুক্ত মনে করছেন না এই অর্থনীতিবিদ। জাহিদ হোসেন বলেন, এখানে সময়টি প্রশ্নবিদ্ধ। যখন খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও প্রায় দুই অংকের ঘরে, সেরকম একটা সময়ে ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবতার নিরিখে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন করা যেতে পারে। যদি, একীভূত করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, সেটা তো আগামী বাজেটে করা যেত।

৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে বলেছে। ‘সে কারণে’ অর্থবছরের মাঝপথে এসে এভাবে হঠাৎ শুল্ক ও করের বোঝা বাড়ানোর পথে হাঁটে সরকার।

কোন পণ্যে কত ভ্যাট
কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়াল, সানগ্লাস, নন-এসি হোটেল, মিষ্টান্ন ভান্ডার, প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা, নিজস্ব ব্র্যান্ড সম্বলিত তৈরি পোশাকের শো-রুম বা বিপণি বিতানে পণ্য ও সেবা বিক্রিতে থাকা বিদ্যমান ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন তা সাড়ে ৭ শতাংশ ছিল।

বৈদ্যুতিক খুঁটি, মোটর গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, ডক ইয়ার্ড, ছাপাখানা, চলচ্চিত্র স্টুডিও, চলচিত্র প্রদর্শনী (সিনেমা হল), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসিং, স্বয়ংক্রিয় বা যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলা আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, বোর্ড সভায় পণ্য যোগানদাতা, টেইলারিং শপ ও টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা, সামাজিক ও খেলাধুলা বিষয়ক ক্লাবে সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

আমদানি করা সুপারিতে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ, পাইন বাদাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, তাজা বা শুকনা সুপারি ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ, আম, কমলালেবু, লেবুজাতীয় ফল, আঙ্গুর, লেবু, পেঁপে, তরমুজ, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, সবজির রস, তামাক, বাদাম, পেইন্টস, পলিমার, ভার্নিশ ও লেকার, সাবান ও সাবান জাতীয় পণ্য, ডিটারজেন্ট, ফ্রুট ড্রিংকস, আর্টিফিশিয়াল বা ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস (কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড), তামাকযুক্ত সিগারেট এসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

যেসব হোটেলে মদ বা মদ জাতীয় পানীয় সরবরাহ করা হয় সেসব হোটেল বা বারের বিলের উপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রেও একইভাবে মদ বা মদজাতীয় পণ্য সরবরাহ করা হলে-তার বিলের উপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।

মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের উপর ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা বা আইএসপির উপর প্রথমবারের মত ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।

পটেটো ফ্ল্যাকস, কর্ন, মেশিন প্রস্তুত বিস্কুট, হাতে তৈরি বিস্কুট, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট বা টমেটো কেচাপ বা সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প, তেঁতুলের পেস্ট, ব্যবহারের অযোগ্য ট্রান্সফরমার অয়েল, লুবব্লেয়িং অয়েল, এলপি গ্যাস, বাল্ক ইম্পোটেড পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, বিআরটিএ থেকে নেওয়া লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স, কঠিন শিলা, ফেরো-ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো-সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো সিলিকন অ্যালয়, এইচ আর কয়েল থেকে সি আর কয়েল, সি আর কয়েল থেকে জিপি শিট, জি আই ওয়্যার, ৫ কেভিএ থেকে ২ হাজার কেভিএ বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম, চশমার মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, নারিকেলের ছোবড়া হতে তৈরি ম্যাট্রেস- এসব পণ্যের ভ্যাট ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

এছাড়া রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশ, ইনভেন্টিং সংস্থার ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ, ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২ দশমিক ৪ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। তবে এলপি গ্যাসের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ২ শতাংশ বাতিল করা হয়েছে।

সিগারেটের চারটি স্তরে দাম ও শুল্ক-দুটোই বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও একইভাবে বাড়ানো হয়েছিল। এর আগে কখনও একই সঙ্গে চার স্তরের দাম ও শুল্ক-কর বাড়ানোর নজির ছিল না।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে। এতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে।

এছাড়া মধ্যমস্তরে ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ; উচ্চস্তরে ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ এবং অতি উচ্চস্তরের দাম ১৬০ থেকে ১৮৫ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে।

লাইম স্টোন ও ডলোমাইটে ১০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।

এতদিন সিগারেটের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক নিম্নস্তরে অন্য তিন স্তরের তুলনায় কম রাখা হত। এবারই প্রথম সম্পূরক শুল্ক একক হারে নেওয়া হল। এ খাত থেকে এই দাম ও কর বৃদ্ধির মাধ্যমে চলতি অর্থবছরের বাকি দিনগুলোতে ৪ হাজার কোটি বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য এনবিআরের।

অপরদিকে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হবে। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হয়। নতুন বিধান অনুযায়ী, বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পেরোলে পণ্য ও সেবা বেচাকেনায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।

উড়োজাহাজের টিকেটের দামও বাড়তে পারে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ রুট ও সার্কভুক্ত দেশের বিমান টিকেটে ৫০০ টাকা হারে আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এটা ২০০ বাড়িয়ে ৭০০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশে বর্তমানের দ্বিগুণ বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2024 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS