তওবা (توبة) আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। পরিভাষায় তওবা বলতে বোঝায় কোনো পাপ বা অন্যায় কাজের জন্য আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে সে পাপ থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করা। মানবজীবনে তওবার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, তওবার মাধ্যমেই কেবল মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর, খাঁটি তওবা।’ (সুরা তাহরিম: ৮)
মানবজীবনে তওবার গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ তওবাকারীর গুনাহ মাফ করে তাকে পরকালে জান্নাত দান করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسٰى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর, খাঁটি তওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। (সুরা তাহরিম: ৮)
আরেক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ التَّوَّابِیۡنَ وَ یُحِبُّ الۡمُتَطَهِّرِیۡنَ অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালোবাসেন। (সুরা বাকারা: ২২২)
ছোট-বড় সমস্ত পাপ থেকে তওবা করা ওয়াজিব। তওবা কবুল হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপার। হকপন্থি আলেমগণের মতে আংশিক পাপ থেকে তওবা করলে সেই তওবা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে এবং অবশিষ্ট পাপ রয়ে যাবে। তওবা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে প্রচুর প্রমাণ রয়েছে এবং এ ব্যাপারে উম্মতের ঐকমত্যও বিদ্যমান।
তওবা করলে মহান আল্লাহ তার গুনাহগার বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি বলেন:
وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِه وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ অর্থ: তিনিই তার বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপসমূহ মোচন করেন। আর তোমরা যা কর, তিনি তা জানেন। (সুরা শুরা: ২৫)
তওবাকারী তওবা করার পর এমন অবস্থায় পৌঁছে যেন সে কোন গুনাহই করেনি অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে তওবাকারী নিষ্পাপ হয়ে যায়। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
التَّائِبُ مِنْ الذَّنْبِ كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ অর্থ: গুনাহ থেকে তওবাকারী সেই ব্যক্তির মত, যার কোন গুনাহই নেই। (ইবনু মাজাহ: ৪২৫০)
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
وَيَتُوبُ اللهُ عَلٰى مَنْ تَابَ অর্থ: আর যে তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা গ্রহণ করেন। (বুখারি: ৬৪৩৪, ৬৪৩৯; মুসলিম: ২৪৬২)
তিনি আরও বলেন:
إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَه بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَه بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ اللَّيْلِ حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহ নিজ হাত রাতে প্রসারিত করেন; যেন দিনে পাপকারী (রাতে) তওবা করে। এবং দিনে তার হাত প্রসারিত করেন; যেন রাতে পাপকারী (দিনে) তওবা করে। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিকে থেকে সূর্যোদয় না হবে, সে পর্যন্ত এই রীতি চালু থাকবে। (মুসলিম: ৭১৬৫)
তওবাকারী বান্দা সফল বান্দা। বান্দা তওবা করলে আল্লাহ খুশী হন। কোন বান্দা গুনাহ করার পর তওবা করলে আল্লাহ কতটা আনন্দিত হন তার উদাহরণ দিয়ে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
اللهُ أَفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِه مِنْ أَحَدِكُمْ سَقَطَ عَلٰى بَعِيرِه وَقَدْ أَضَلَّه فِي أَرْضِ فَلَاةٍ অর্থ: আল্লাহ নিজ বান্দার তওবা করার জন্য ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী আনন্দিত হন, যে তার উট মরুভূমিতে হারিয়ে ফেলার পর পুনরায় ফিরে পায়। (বুখারি: ৬৩০৯; মুসলিম: ৭১২৮)
সহিহ মুসলিম-এর অন্য বর্ণনায় এভাবে এসেছে যে,
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِه حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلٰى رَاحِلَتِه بِأَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُه وَشَرَابُه فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتٰى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِى ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِه فَبَيْنَا هُوَ كَذٰلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَه فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ اللّٰهُمَّ أَنْتَ عَبْدِى وَأَنَا رَبُّكَ.أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ
অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহ তার বান্দারতওবায় যখন সে তওবা করে তোমাদের সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশী খুশি হন, যে তার বাহন (উট)-এর উপর চড়ে কোন মরুভূমি বা জনহীন প্রান্তর অতিক্রমকালে বাহনটি তার নিকট থেকে পালিয়ে যায়। আর খাদ্য ও পানীয় সব ওর পিঠের উপর থাকে। বহু খোঁজাখুঁজির পর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে বাহনটি (উটটি) হঠাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। সে তার লাগাম ধরে খুশির চোটে বলে ওঠে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আর আমি তোমার রব!’ সীমাহীন খুশির কারণে সে ভুল করে ফেলে। (মুসলিম: ৭১৩৬।) উল্লেখ্য, এ জাতীয় অনিচ্ছাকৃত ভুল মার্জনীয়।
তওবা আল্লাহর রহমতের অংশ। বান্দা গুনাহ করলে আল্লাহ তার রহমতের কারণে বান্দাকে মাফ করে দেন। তবে তার জন্য বান্দাকে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। শুধু তওবা-ই নয়, তওবার পর সৎ ‘আমলের উপরে অটল থাকতে হবে, তাহলেই আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দিবেন। আল্লাহ তার এই রহমতের কথা এভাবে বলেছেন,
وَإِذَا جَاءَكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِنَا فَقُلْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلٰى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ أَنَّه مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سُوءًا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِنْ بَعْدِه وَأَصْلَحَ فَأَنَّه غَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থ: আর যারা আমাদের আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, তারা যখন তোমার কাছে আসে, তখন তুমি বল, ‘তোমাদের উপর সালাম’। তোমাদের রব তার নিজের উপর লিখে নিয়েছেন দয়া, নিশ্চয় যে তোমাদের মধ্য থেকে না জেনে খারাপ কাজ করে তারপর তওবা করে এবং শুধরে নেয়, তবে তিনি অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা আনয়াম: ৫৪)
মহান আল্লাহর এই রহমতের শতকরা মাত্র ১ ভাগ অর্থাৎ ১০০ রহমতের মধ্যে মাত্র ১টি রহমত দুনিয়ার সকল সৃষ্টির মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। এই রহমতের কারণেই মা-বাবা তাদের সন্তানকে লালনপালনে এতো কষ্ট সহ্য করেন এবং আদর করেন। গাভি তার বাছুরকে জিহ্বা দিয়ে আদর করে। আরও যত রহমত ও দয়ার দৃষ্টান্ত আমরা সৃষ্টিজগতে দেখতে পাই তার সবকিছুই আল্লাহর ১০০টি রহমতের ১টির প্রভাব। বাকী ৯৯টি রহমত আল্লাহ কিয়ামতের জন্য রেখে দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন:
إِنَّ اللهَ خَلَقَ الرَّحْمَةَ يَوْمَ خَلَقَهَا مِائَةَ رَحْمَةٍ فَأَمْسَكَ عِنْدَه” تِسْعًا وَتِسْعِينَ رَحْمَةً وَأَرْسَلَ فِىْ خَلْقِهِ كُلِّهِمْ رَحْمَةً وَاحِدَةً فَلَوْ يَعْلَمُ الْكَافِرُ بِكُلِّ الَّذِىْ عِنْدَ اللهِ مِنْ الرَّحْمَةِ لَمْ يَيْئَسْ مِنْ الْجَنَّةِ وَلَوْ يَعْلَمُ الْمُؤْمِنُ بِكُلِّ الَّذِىْ عِنْدَ اللهِ مِنْ الْعَذَابِ لَمْ يَأْمَنْ مِنْ النَّارِ
অর্থ: আল্লাহ যেদিন রহমত সৃষ্টি করেন সেদিন ১০০টি রহমত সৃষ্টি করেছেন। ৯৯টি তার কাছে রেখে দিয়েছেন এবং ১টি মাত্র রহমত সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যদি কাফির আল্লাহর কাছে সুরক্ষিত প্রতিটি রহমত সম্পর্কে জানে তাহলে সে জান্নাত লাভে নিরাশ হবে না। আর মুমিন যদি আল্লাহর কাছে যে শাস্তি আছে সে সম্পর্কে জানে তা হলে সে জাহান্নাম থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে না।(বুখারি: ৬৪৬৯।) আর দুনিয়ার ঐ ১টি রহমতের কারণেই আল্লাহ বান্দার ছোট-বড় সকল গুনাহ মাফ করেন।
বান্দার হক মহান আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। যে ব্যক্তির হক নষ্ট করা হয়েছে তার থেকেই ক্ষমা নিতে হবে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply