বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৪ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ
লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, মাস্টারকার্ড ও প্রিয়শপ এর যৌথ উদ্যোগে সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য কো-ব্র্যান্ডেড টাইটেনিয়াম ক্রেডিট কার্ড চালু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান: মির্জা ফখরুল আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিশেষ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে ফরেন রেমিট্যান্স হাউসগুলোর মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত দেশে প্রথমবারের মতো আর্মরশেল প্রটেকশনের ফোন নোট ৬০ এনেছে রিয়েলমি শেখ হাসিনাসহ সহযোগীদের বিচার দাবি ফারুক হাসানের বীরগঞ্জে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত সিলেটের গোয়াইনঘাট রাতারগুল হারাচ্ছে পর্যটন আকর্ষণ, কমছে পর্যটক আইএফএ ২০২৪ প্রদর্শনীতে অনারের চমক সচিবদের চাকরির তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ

ফেইসবুকে ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন পোস্ট- বুলিং, টার্গেট ছাত্রীরা

মো. নাজমুল হোসেন (বগুড়া)
  • আপডেট : বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪
  • ২৭৭ Time View

চলতিপথে কোনো মেয়েকে রাস্তায় দেখলেন, স্কুলের পথে দেখলেন- কিংবা কোনোভাবে পছন্দ হয়ে গেলো কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছেন না? নিজ নাম পরিচয় গোপন রেখেই সেই না বলা কথা বলার জন্য আছে – ফেইসবুক ভিত্তিক ক্রাশ এন্ড কনফেশন পেইজ বা গ্রুপ। ঠিক এরকমই ধারণা নিয়েই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ছাত্রীর ছবি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির করা কনফেশনগুলো ছড়িয়ে দিয়ে বিপাকে ফেলা হচ্ছে স্কুলছাত্রীদের।

নিতান্তই মজা করার জন্য ‘ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ ও জেলাভিত্তিক পেইজ চালু আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে। এসব পোস্ট করার কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া মেয়ে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া ঝুঁকিতে পড়ছে তাদের ভবিষ্যৎ এবং নিশ্চিত হচ্ছে না তাদের সুরক্ষা।

ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে  আপত্তিকর মন্তব্য, ইনবক্সে আপত্তিকর ম্যাসেজ, ছবি পাঠানো, বিভিন্ন মিম, ট্রল বানিয়ে সামাজিকভাবে হয়রানি করার পরিমাণ মারাত্মক হারে বেড়েছে। এ থেকে বাড়ছে হতাশা, নারী, শিশু ও ছাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতা। এর মাধ্যমে অনেকে হচ্ছেন বুলিংয়ের শিকার। 

অপরিচিত একজনের ছবি দিয়ে কাব্যিক ভাষায় বা কখনও আবেগময় কথার বাচন ভঙ্গি দিয়ে নিজের ভাষাগত দক্ষতা দেখিয়ে পোস্ট করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তব ও আইনগত দিক দিয়ে কতটুকু যুক্তিযুক্ত এই ধরনের প্রেম নিবেদন বা প্রচলিত আইন কতটুকু সমর্থন করে এই অনলাইন ভিত্তিক রোমিও-জুলিয়েটদের? 

জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) সাইবার বুলিংয়ের সংজ্ঞায় বলছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত করাকে বলে সাইবার বুলিং। আর এই উত্ত্যক্ত করার কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, খুদে বার্তা, গেমিং প্ল্যাটফর্ম বা মুঠোফোন।

এসব পেইজ ঘেটে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের ছবিসহ নাম-পরিচয় দিয়ে প্রেম নিবেদনের বিভিন্ন কথা বার্তা পোস্ট করা হচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েদের ছবি দিয়ে পরিচয় উন্মুক্ত করে পোস্ট করা হয় বিয়ে কিংবা প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে। অথচ যার ছবিসহ পোস্ট দেয়া হচ্ছে তিনি কিছুই জানেন না! 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন যুক্ত করে ফেইসবুকে পেইজ খুলে হয়রানির অভিযোগ তুলে ২০১৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক ছাত্রী থানায় জিডি করেন। কারণ হিসাবে বলা হয়, ছবিসহ ওই ছাত্রী সম্পর্কে অশ্লীল, অশ্রাব্য, কুরুচিপূর্ণ এবং যৌন হয়রানিমূলক তথ্য প্রকাশ করা হয়। মুহূর্তেই পোস্টটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ভিউ করেন। কমেন্টের স্থলেও শুরু হয় ‘বিদ্বেষমূলক’ মন্তব্য। 

বগুড়ার ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির জেরিন (ছদ্মনাম) নামের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলে, তাকে নিয়ে একবার এরকম একটি গ্রুপে ছবি পোস্ট করে তার পরিচিত ফেইসবুক বন্ধুরা তাকে ম্যানশন করে ওই পোস্টে। পরে নানা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যে ভরে যায় কমেন্টে। এরপর ওই পেইজে মেসেজ করে পোস্টটি রিমুভ করা হয়। 

অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মার্জিয়ার হেটে চলার সময় পিছন থেকে কেউ একজন ছবি তুলে তা পোস্ট করে ‘ বগুড়া ক্রাস এন্ড কনফিউশান গ্রুপে ’ তাতে মার্জিয়া নামের শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করে তার কয়েকজন বান্ধবী। নানান বিষয়ে কমেন্ট করে ভরে ফেলে ওই পোস্টে। পরে পেইজে অনুরোধের পরও তা ডিলিট করা হয় নি বলে জানান তিনি। ১৫ হাজারেরও বেশি ফলোয়ার সক্রিয় পেইজে। 

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের মনোয়ারা নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, যদি কখনো গ্রাম্য অঞ্চলের কাউকে নিয়ে পোস্ট করা হয় আর তা যদি কেউ বুঝতে পারে। তাহলে তো অবস্থা কঠিন থেকে ভয়াবহ ! পরিবারগুলোকে এসব বোঝানোই দায়! অথচ শহুরে থাকা মেয়েদের পরিবারগুলো অনেক সময় এসব সমস্যা বুঝতে পারে। 

তিনি আরো বলেন, ‘আমার ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মামাতো বোনকে নিয়ে এরকম পোস্ট করা হয়। পরিবারের সদস্যদের নজরে আসলে পড়াশোনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ’

নিজের বার্তাটি ‘সেন্ড মেসেজ’ অপশন অথবা ‘ই-মেইল’ এর মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলে এডমিনরা সেটা পেইজে প্রকাশ করে আর লেখার সাথে জুড়ে দেয় প্রাপকের ছবি। 

‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন-২০১৮’ এর ২৬ ধারায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির পরিচিত তথ্য (পরিচিত তথ্য বলতে নাম, ছবি, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জন্মতারিখ, ফোন নাম্বার ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে) সংগ্রহ, বিক্রয়, দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি উপধারা ২ অনুসারে অনধিক ৫ (পাঁচ) বছরের কারাদণ্ড বা ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

উক্ত আইনের ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহলে উক্ত কাজটি আইনের চোখে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এমনকি শাস্তির ক্ষেত্রে মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রয়েছে, সহায়তাকারী ব্যক্তি সেই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

অনেক সময় নিজ বন্ধু-বান্ধবরা নিজেরদের বন্ধু বা বান্ধবীর নামে ফেইক কনফেশন পোস্ট করেন। যা বেশির ভাগ ঘটে থাকে ছেলেদের সাথে। অনেকেই পরবর্তীতে নানা ধরনের বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হন। 

নিঝুম শাহরিয়ার নামের একজন বলেন, ‘একবার আমাকে নিয়ে এরকম পোস্ট করা হয়েছিল। পরে জানতে পারি আমারই এক বন্ধু মজা করার জন্য পোস্ট করেছে। যদিও অনেক বন্ধু বাজে মন্তব্য করতে দ্বিধা করে নি। ’

ইমরোজ জাহান নামের এক অভিভাবক মনে করেন, ছবি এভাবে অনুমতি না নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার কারণে ইভটিজিং থেকে শুরু করে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। অনুমতি ছাড়া নাম বা ছবি এসব পাবলিক প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করা হয়, যা পরবর্তীতে তাদের সামাজিক, পারিবারিক জটিলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই পেজগুলোতে বিভিন্ন ছেলে-মেয়ের নামে এখন পর্যন্ত হাজারেরও বেশি কনফেশন পোস্ট করা হয়েছে, যার সিংহভাগই স্কুল-কলেজে পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থীদের। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টার্গেট মাধ্যমিক পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী। এসব ছবি প্রকাশ করা ছাড়াও, বিভিন্ন অরুচিকর কন্টেন্ট তৈরীরও অভিযোগ উঠেছে পেইজগুলোর বিরুদ্ধে।

সামাজিক মাধ্যমে এসব পোস্টে টার্গেট হওয়া শিক্ষার্থীদের বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়র, অভিভাবক কিংবা শিক্ষকসহ ব্যবহারকারীরা দেখে থাকেন পোস্টগুলো। মন্তব্যের ঘরে কেউ কেউ লিখেন বাজে অশালীন মন্তব্য, কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই চলে বুলিং, অযাচিত অশোভন কথাবার্তা ; আবার কেউবা প্রতিবাদী। তবে সব সমালোচনা শুনতে হচ্ছে ওই ছাত্রীকেই! কারণ পোস্টদাতার নেই কোনো নাম-পরিচয়! কখনো পরিবার কিংবা সমাজের রোষানলে পড়তে হয় ভুক্তভোগীকে।

ভয়ংকর বিষয় হলো- চাইলেও এসব ঘটনা সত্যি কিনা, তা জানার উপায় নেই ছাত্রীর বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচিত কোনো ব্যক্তির। খোদ ভুক্তভোগী ছাত্রী যখন ওই পেজের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে জানতে চেয়ে টেক্সট করেন, তখন প্রতিউত্তর আসে- কোনো দায় নেই কর্তৃপক্ষের ! যে, যা দেয় এডমিন প্যানেল তাই পাবলিশ করে।

কাজী সিফাত (ছদ্মনাম) নামের এক এডমিন জানান, অনেক সময়ই আমরা পেইজের ইনবক্সে বিভিন্ন পোস্ট নিয়ে গালিগালাজ বা মামলা হামলার হুমকি পাই। অনেকেই তাদের সমস্যার কথা শেয়ার করেন। সেক্ষেত্রে আমরা অনেকের পোস্ট আনপাবলিশ করে দেই। তবে আমরা পজিটিভ রেসপন্সই বেশি পাই। মানুষকে বিনোদন দিতে পেরে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। 

বগুড়া সরকারি কলেজের মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক মো. রাকিব হাসান বলেন, ‘একপ্রকার যৌন নিপীড়নের হাতিয়ার ‘ক্রাশ এন্ড কনফেশন’ এই পেইজগুলো।একজন ছাত্রীর সম্পর্কে যখন নেতিবাচক তথ্য প্রকাশ হয়, সে যত স্ট্রং মানসিকতারই হোক না কেন; স্থির থাকতে পারবে না। আমাদের সমাজে তো আরও নয়ই! এখানে মেয়েদের সম্পর্কে মিথ্যা বানিয়ে বললেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সবচেয়ে কাছের মানুষ বা অভিভাবকরাও তা বিনাবাক্যে সত্য মনে করে। ফলে ভুক্তভোগীর পক্ষে এ ধরনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়াটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।’

ফেইসবুক ঘেঁটে দেখা যায়, এই পেজের এই ধরনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করছেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই পেইজগুলো দ্বারা ভার্চুয়াল টিজিং এর কবলে নিয়মিত পড়ছেন নারীরা। 

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, এসব কর্মকাণ্ড সাইবার অপরাধ। নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া পুলিশের সাইবার ইউনিটের তৎপরতা চালু আছে। অনলাইনেও অভিযোগ করার সুযোগ আছে। পাশাপাশি এসব বন্ধে পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2024 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS