নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন।
জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম কর্তৃক আয়োজিত আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আছেন আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বিলস-এর পরিচালক নাজমা ইয়াসমীন, বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আশরাফ উদ্দিন মুকুট, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি’র সহ-সভাপতি এডভোকেট সীমা জহুর, ফেয়ারওয়্যার ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ম্যানেজার মোঃ বাবলুর রহমান, ইন্ড্রাট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল এর সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম রাজু, কর্মজীবী নারী’র নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সানজীদা সুলতানা, মনডিয়াল এফএনভি’র কনসালটেন্ট মোঃ শাহীনুর রহমানসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ।
কর্মস্থল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল ধরনের সহিংসতা ও যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার/শ্রমিক সংগঠনগুলোর জোট “জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। বর্তমানে এই জোটের সদস্য হলো আওয়াজ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ- বিস, বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন (বিএলএফ), বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলও), ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি) এবং কর্মজীবী নারী। গঠনের পর থেকেই কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের লক্ষ্যে বিগত ২০০৯ সালে প্রদত্ত মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে কারখানা/প্রতিষ্ঠান-এ যৌন হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে “কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন” (খসড়া) প্রণয়নের কাজ শুরু করে এই প্ল্যাটফর্ম। শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও শ্রমিক সংগঠন যারা জেন্ডার প্ল্যাটফর্মের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে এবং তা অনুসরণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে তারাই প্ল্যাটফর্মের সিদ্ধান্তক্রমে সদস্যপদ লাভ করে।
১. যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন প্রণয়নের জন্য পলিসি অ্যাডভোকেসি;
২. ২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ;
৩. হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানা/ প্রতিষ্ঠানসমূহে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও কার্যকরীকরণে
উদ্যোগ গ্রহণ;
৪. তথ্য, গবেষণা, ডকুমেন্টেশন ও প্রকাশনার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি;
৫. বিভিন্ন শ্রমঘণ এলাকায় আঞ্চলিক কমিটির সাথে প্রশিক্ষণ ও সভা;
৬. আইএলও কর্তৃক প্রণীত কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন করার বিষয়ে অ্যাডভোকেসি।
কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি উত্থাপন। কর্মক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের যৌন হয়রানি প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করে যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। যৌন হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। সে সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক যৌন হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটে এবং তা সংবাদপত্রে প্রকাশ হতে থাকে। যেমন, ২০০৬ সালের মে মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল আমান-এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। একই বছর নভেম্বর মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। গার্মেন্টস, এনজিও সহ নানা ক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট ‘দি ডেইলি স্টার’ যৌন হয়রানি বন্ধে কোন আনুষ্ঠানিক অভিযোগে শুনানির ব্যবস্থা না থাকার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার প্রেক্ষিতে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি রিটটি দায়ের করে এবং এর আলোকে ২০০৯ সালের ১৪ মে মহামান্য হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১১টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচ দশকে বাংলাদেশের নারীদের জীবনমানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পড়াশোনা ও কর্মক্ষে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত কয়েক দশকে নারীরা পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করলেও দেশে এখনো নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, শ্রীলতাহানি, ইভটিজিং এবং ধর্ষণ-হ নারীদের প্রতি সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসছে না। বরং এখন নারীর প্রতি সহিংসতার হার বেশ উদ্বেগজনক। গণপরিবহণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, এমনকি অনেক নারী নিজের পরিবারেও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণির মানুষই বেশিরভাগ সহিংসতার শিকার হন। বিশেষ করে নারী ও শিশু, অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষ এবং সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ সহিংসতার শিকার হন।
“নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন”, “বাংলাদেশ শ্রম আইন” ইত্যাদি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কেন কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে পৃথক আইন প্রয়োজন সে বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট তার রাখে বিস্তারিত জানিয়েছেন। রায়ে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, কোর্টের এই আদেশ ও নির্দেশনাগুলো জাতীয় সংসদ কর্তৃক এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত ও কার্যকর আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত অনুসৃত ও পরিপালিত হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা গেছে একদিকে যেমন মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ মতো কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো আইন পাশ হয়নি তেমনি এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট যে ১১টি নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলোও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে “কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন, ২০১৮”-এর একটি প্রস্তাবিত খসড়া তৈরি করে এবং একই বছর আইন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বরাবর আইনের খসড়াটি পেশ করা হয়।
কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে নারীরাও। সরকারি- বেসরকারি চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় এখন নারীরা কর্মরত। পাশাপাশি নানা ধরনের সমস্যায়ও তারা পড়ছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা এখনো বৈষম্যের শিকার। উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো যৌন হয়রানি। শারীরিক, মানসিক, মৌখিক, বিভিন্নভাবে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারীর নিরাপত্তার বৈষম্য খুবই প্রকট। দিনে দিনে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানির মাত্রা বেড়েই চলেছে এবং বর্তমানে তা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে মোট ৩০৬৭ নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধুমাত্র অক্টোবর মাসেই মোট ৩৭১ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে- এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬২ জন কন্যাসহ ৯১ জন। তার মধ্যে ১২ জন কন্যা ও ১০ জন নারীসহ ২২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ২ জন কন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ৫ জন কন্যাসহ ১০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। নারী ও কন্যা পাচারের ঘটনা ঘটেছে ৬৩ টি- এর মধ্যে ১৮ জন কন্যা। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে ৩৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১২৩৫ জন। তন্মধ্যে ৬২৯ জন কন্যাশিশুসহ ১০১৮ জন ধর্ষণের শিকার, ৫৬২ জন কন্যাশিশুসহ ১৭৯ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২২ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৩১ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ৭ জন। এছাড়াও ১৩ জন কন্যাশিশুসহ ১৫৫ জন ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। (বাংলাদেশ মহিল পরিষদ এর ওয়েবসাইট)
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই দশ মানে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৩০ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৯ নারী, আর এ কারণে আগ্রহত্যা করেছেন ৭ জন। এ ছাড়া আর ১৪১ নারীকে ধর্ষনের চেষ্টা চালানো হয়েছে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ঢাকা জেলায় সর্বাধিক ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। এরপর নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নোয়াখালী জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবন্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন মোট ১ হাজার ৬২৭ জন নারী এবং ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪১৩। (আইন ও সালিশ কেন্দ্র-এর ওয়েবসাইট)
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে যে ধরনের ফোন আসে, সেই তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারীকে হয়রানি, নিপীড়ন, আর সহিংসতার অভিযোগ জানাতে বা সাহায্য চেয়ে ফোন কলের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। এ বছর অগাস্ট পর্যন্ত এ ধরনের কল এসেছে মোট ১৩ হাজার ৪১৬টি, যেখানে ২০২১ সালে পুরো বছর মিলে এমন কলের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ১৬৯টি। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৩৬১টি। (বিডিনিউজ২৪.কম)
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস এর সংবাদপত্রভিত্তিক জরিপ অনুযায়ী ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০৭ জন নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন। এরমধ্যে কর্মস্থলে ৩৯ জন এবং কর্মস্থলের বাহিরে ৬৮ জন নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন গত মার্চ মাসে তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন ৬৪.৯২ শতাংশ নারী। এই সংখ্যাটি অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর হয়রানির মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪৩.৮৯ শতাংশ নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন। হয়রানির স্থান হিসেবে বাস ও বাসস্টেশন- এ দুটিকে উল্লেখ করেছেন সমীক্ষায় অংশ নেওয়া নারীরা। দুই জায়গা মিলে হয়রানির হারটা অবশ্য অনেক বড়- ৮৪.১০ শতাংশ। রেল ও রেলস্টেশনে এই হার ৪.৫৮ শতাংশ। আর রাইড শেয়ারিং সেবায় ১.৫৩ শতাংশ নারী হয়রানির শিকার হন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া তরুণীদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী নিজের শরীরের গড়ন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। তার মধ্যে ৩৭ দশমিক ২৪ শতাংশ তরুণী নিজের আত্মীয়স্বজন ও ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন, তারা নিজেদের পরিবার থেকে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন। (কালের কন্ঠ, ৫ মার্চ ২০২২)
নারীরা যে কোথাও নিরাপদ নয় তা এসব ঘটনা আবারো প্রমাণ করেছে। নারী এবং নিরাপত্তা- শব্দ দুটি যেন আমাদের সমাজে ক্রমশ বিপরীতমুখী শব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চলেছে। ঘরে-বাইরে, পরিবারে, লোকালয়ে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, গণপরিবহণে এমনকি লাশকাটা ঘরে মৃত নারীও নিরাপদ নন। নারীর নিরাপত্তা এখন বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন। সমাজ জীবনের এমন একটি জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে নারী নিরাপদ, যেখানে নারীকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। না। এই নিরাপত্তাহীনতার অবসান কিভাবে ঘটবে সেটাই প্রশ্ন?
আইএলও কর্তৃক প্রণীত কনভেশন ১৯০ যার বিষয় হলো “ইলেমিনেশন অব ভায়োলেন্স এন্ড হেরাসমেন্ট ইন দি ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক”। এই কনভেশনটি ২০১৯ সালের ২১ জুন আইএলও’র ১০৮তম আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে গৃহীত হয়। এ পর্যন্ত ২২ টি দেশ ‘সহিংসতা ও হয়রানি সনদ- ২০১৯ (আইএলও কনভেনশন-১৯০)’ অনুস্বাক্ষর করেছে। অনুমোদনের দুই বছর পর এটি চলতি বছরের ২৫ জুন থেকে বিশ্ব পরিমন্ডলে কার্যকর হয়েছে (যুগান্তর, ২৫ জুন ২০২১)। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে এই কনভেশনটি বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত হলে তা বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদৃঢ় করবে, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করবে। সেজন্য প্রয়োজন, এই কনভেনশনটি যথাযথ পর্যালোচনা করে অনুস্বাক্ষরের জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস দ্রুততম সময়ের মধ্যে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন’ পাশ ও আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর বাংলাদেশের ভয়াবহতার চিত্র পাল্টাতে ও সর্বক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
নারীর মানবাধিকার দলিল হিসেবে জাতিসংঘ ১৯৭৯ সালে সিডও সনদ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে ৪টি ধারার উপর সংরক্ষণ রেখে সিডও সনদ স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে নারী আন্দোলনের ফলে সরকার ২টি ধারার উপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে নেয়। অন্য দুটি ধারার ওপর এখনও সংরক্ষণ তুলে নেয়নি সরকার।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)-এর বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী অধিকার ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ব্যবধান ঘোচানোর সূচকে এক বছরের ব্যবধানে ছয় ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে বাংলাদেশ ৭১ নম্বরে নেমে গেছে। গত বছর এ তালিকায় বাংলাদেশ ৬৫ নম্বরে ছিল। তার আগের বছর ছিল ৫০তম অবস্থানে। (বণিক বার্তা, ১৫ জুলাই ২০২২)
নারীর প্রতি সহিংসতা-নারীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বাধা। এটা কোনো একক সমস্যা না। এটা বৈশ্বিক সমস্যা। পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতা পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে হবে। নারীর প্রতি এ সহিংসতা রোধে নতুন আইন প্রণয়ন ও পুরাতন আইনগুলোকে সংস্কার করতে হবে এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারী নির্যাতনের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। এখনো সমাজের চোখে নারীদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। যার ফলে নারীরা নির্যাতনের শিকার হলেও তা কারও কাছে প্রকাশ করতে পারে না। এমনকি অনেকে নিজের পরিবারেও বলতে পারে না। আবার কখনো কোনো নারী তার প্রতি করা সহিংসতামূলক আচরণের প্রতিবাদ করলে, বেশিরভাগ মানুষ উল্টো ভুক্তভোগী নারীকেই দোষারোপ করে বা করার চেষ্টা করে।
জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ মনে করে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। অবশ্য শুধু আইন দিয়েই আমরা আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি করা অমানবিক আচরণ বন্ধ করতে পারব না। এজন্য আমাদের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি।
নারীর প্রতি হয়রানি ও নির্যাতন রোধে আমরা জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ আপনাদের মাধ্যমে সরকারের কাছে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবি উল্লেখ করছি :
১. যৌন হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে “কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন” প্রণয়ন
করতে হবে;
২. কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি নিরসন বিষয়ক আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন করতে হবে;
৩. যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে প্রদানকৃত হাইকোর্টের নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে; কর্মস্থলে যাতায়াতের পথে এবং সমাজে নারী শ্রমিকের যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে
হবে;
৪. আদালতের নির্দেশনা যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, সে জন্য সরকারি উদ্যোগে একটি তদারকি কমিটি
গঠন করতে হবে;
৫. যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নারী ও শিশু
নির্যাতনের বিচার নিষ্পত্তি করা ও বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন করতে হবে;
৬. বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর সংশোধনীতে (১ সেপ্টেম্বর ২০২২ প্রকাশিত গেজেট) মহিলাদের প্রতি আচরণ সংক্রান্ত নতুন বিধি ৩৬১ক এবং সেই বিধির (২) এ বর্ণিত অভিযোগ কমিটি গঠন মহামান্য হাইকোর্টের প্রদানকৃত গাইডলাইন’-এর ভিত্তিতে করতে হবে;
৭. নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply