নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনার পর এখন জাহাজ নির্মাণ শিল্পে সুবাতাস বইছে বরিশালেও। গত এক দশকে কীর্তনখোলা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০ থেকে ১২টি ডকইয়ার্ড। যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে ছোট-বড় লঞ্চ, যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী জাহাজ। বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচলকারী বেশিরভাগ বিলাসবহুল নৌযানই তৈরি এসব ডকইয়ার্ডে। দেশি-বিদেশি প্রযুক্তির মিশ্রণে স্থানীয় শ্রমিকরাই নির্মাণ করছে তারকা মানের এসব জলযান। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক মানুষের।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, গ্যাস, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং স্বল্প সুদে ঋণ পেলে বরিশালে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ করা সম্ভব বলেও মনে করেন উদ্যোক্তারা। কোনো ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই এগিয়ে যাচ্ছে কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা জাহাজ নির্মাণ শিল্প। লাগসই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেই এই শিল্পে ইতোমধ্যে অর্ধ শতাধিক ছোট-বড় যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান নির্মিত হয়েছে। সম্পূর্ণ বেসরকারি খাতে গড়ে ওঠা এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণও ইতোমধ্যে ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
প্রতি বছর অন্তত ৫-৬টি জাহাজ নির্মাণ করা হয় বরিশালে। তবে বিদ্যুৎ ঘাটতিসহ ভ্যাট ও আগাম আয়করের খড়গ রয়েছে। অথচ মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে ভোলায় গ্যাস থাকলেও গ্যাসনির্ভর এই শিল্পে নেই কোনো গ্যাস সুবিধা। ফলে প্রতিনিয়ত এসব বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেই টিকে আছে বরিশালের জাহাজ নির্মাণ শিল্প। ভোলার গ্যাস বরিশালে এলে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে খরচ অনেক কম হতো। তাছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ খরচও বেশি। , উদ্যোক্তাদের আগ্রহ থাকলেও এখনো বরিশালের নৌযান নির্মাণ শিল্পে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বিনিয়োগের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
বরিশালে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সুরভী শিপিং লাইনসের পরিচালক রিয়াজ-উল কবির জানান, বরিশালে এ ব্যবসার গোড়াপত্তন ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তখন বরিশালে দক্ষ কারিগর পাওয়া যেত না। ঢাকা থেকে শ্রমিক এনে বরিশালে জাহাজ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছিল। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে বরিশালের শ্রমিক ও কারিগররা এখন অনেক দক্ষ হয়েছেন। ফলে বাইরে থেকে এখন আর শ্রমিক আনতে হয় না। দেশের যে কোনো স্থানের চেয়ে বরিশালে মজুরিও কম। এ কারণেই বরিশালে জাহাজ নির্মাণ করলে ৩০ ভাগ খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। বরিশাল চেম্বার এন্ড কমার্সের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, বর্তমানে বরিশালে ছোট-বড় প্রায় ২০টি শিপইয়ার্ড রয়েছে। আর এতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন দুই সহস্রাধিক শ্রমিক ও কর্মচারী। এখানকার শিপইয়ার্ডেই নির্মিত হয়েছে যাত্রীবাহী এমভি কীর্তনখোলা-১, ২ ও ১০, এমভি সুন্দরবনসহ অসংখ্য বিলাসবহুল জাহাজ। নির্মাণাধীন রয়েছে প্রায় ২০টি ছোট-বড় নৌযান।
জাহাজ শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, বরিশালে জাহাজ শিল্পের অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে নদী ভাঙন। সুন্দরবন শিপইয়ার্ডের নিজস্ব ৩ একর জমির অর্ধেকই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অন্যান্য শিপইয়ার্ডেরও একই অবস্থা। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ইতোমধ্যে বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বরগুনার পাথরঘাটায় শিপ ব্রেকিং কার্যক্রম শুরু করার জন্য জরিপের কাজ এগিয়ে চলছে। এটা চালু হলে জাহাজের কাঁচামাল সংগ্রহে চট্টগ্রাম যেতে হবে না। তাছাড়া অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে পাথরঘাটায়। ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের মতে, প্রতি বছর ৭০০টি জাহাজ কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে বিক্রি করে দেয়া হয়। এ পুরনো জাহাজ ক্রেতাদের ভিড়ে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে।
বাংলাদেশের রড তৈরির কারখানাগুলোতে জাহাজ ভাঙা কাঁচামালের একটা অংশ জোগান দেয়। এতেই এ খাতটি শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। বর্তমান জাহাজ ভাঙা শিল্পকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ জাহাজের সব উপকরণ পুনঃব্যবহারযোগ্য। এই শিল্প যেমনভাবে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের জোগান দিচ্ছে, তেমনিভাবে এ শিল্প থেকে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, যা আমরা আমাদের বাসাবাড়িতে ব্যবহার করছি। বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু, পায়রা সমুদ্র বন্দরের পাশাপাশি পাথরঘাটায় শিপ ব্রেকিং কার্যক্রম শুরু হলে এ অঞ্চলের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। অবশ্য এ জন্য তারা ভোলা থেকে বরিশালে গ্যাস আনা এবং সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের দাবি জানিয়েছেন। মোট কথা, জাহাজ নির্মাণ শিল্প গড়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বরিশালে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply