মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৩:৩১ পূর্বাহ্ন

প্রতিশ্রুতি- উম্মে কুলসুম ঝুমু

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : সোমবার, ৭ জুলাই, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আই হসপিটাল, ধানমন্ডি। বিকাল ৫টা। ডেস্কে কাগজ জমা দিয়ে ওয়েট করছি। এর মধ্যে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়েছেন একজন বয়স্ক মহিলা। অতিমাত্রায় বয়স্ক। বার্ধক্যের কারণে হাঁটতে পারে না, তাই হুইলচেয়ারে।

আমিও অপেক্ষমাণ, কখন ডাক আসবে- সিরিয়াল নাম্বার ৭। কী আর করা-এই একটা জায়গায় আজও মানুষ যেন খুব অসহায়। ডাক্তারের কথার ওপরই যেন টিকে থাকা। ডাক্তার সব দেখে যদি সিদ্ধান্ত নেয় আমি ভালো আছি, তাহলে ভালো থাকা। আর ডাক্তার যদি বলে শেষ, তাহলে যেন নিমেষেই সব অন্ধকার, সব শেষ। শরীরও যেন ডাক্তারের বাধ্য। তবে আমার ডাক্তারভীতি আছে। ডাক্তার দেখাতে যত অলসতা। বয়স ৪০ ছুঁই ছুঁই করছে, এখনো চশমা ছাড়াই চলছি। তবে দূরের জিনিস ইদানীং বেশি স্পষ্ট লাগছে। কাছ থেকে দেখলে ঝাপসা লাগে। দুই-চারজন বন্ধুর সাথে সমস্যাটা বলেছি। বললো, আমার বয়সের সাথে চরিত্রটা নষ্ট হচ্ছে। বুঝতে পারিনি প্রথম, বয়সের সাথে বুঝি চরিত্রের যোগসাজশ আছে। বললাম, ব্যাখ্যা কর। ওরা বললো, ‘জামাই তো কাছের মানুষ, তুমি এখন কাছে রেখে দূরেরটা ভালো দেখো।’ এতক্ষণে বুঝলাম, ‘তোরা ফান করছিস। আমি সিরিয়াস।’ বললো, ‘এই বয়সে এমন একটু হতেই পারে, এটা নর্মাল।’ বুঝতেই পারিনি, ৪০ বছর মানে অনেকটা সময়। হয়তো আর অল্পসময় বাকি। একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস জমাট বেঁধেছে বুকের মধ্যে। তারপর আর দেরি নয়, সকাল হতেই ডাক্তারের সিরিয়াল এবং অবশেষে চোখ দেখাতে আসা।

সিনেমা দেখতে গিয়ে আড়াই ঘণ্টা অনায়াসে বসে থাকা যায়, অথচ ডাক্তারের কাছে এসে ওয়েটিংয়ে আধঘণ্টা মানে এক দিনের সমান। ডাক্তারের সিস্টেমও বুঝি না বাপু, তারা তো বুঝতে পারে, একজন রোগী দেখতে আনুমানিক কত সময় লাগে। তেমন পেশেন্ট হিসাব করে টাইম ফিক্সড করে দিলেই পারে। তা না, বলবে, সময় হাতে নিয়ে আসবেন। তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা।

এখন তো তবু ২-৩ ঘণ্টা অনায়াসেই কাটিয়ে দেয়া যায়, যদি হাতে বর্তমান প্রযুক্তির একখানা মোবাইল ফোন হাতে থাকে। আমার চোখ মোবাইল ফোনের ফেইসবুকে আটকে ছিলো। জ্বল করে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। এটাও যেন ভালো লাগা- কারণবিহীন স্কুল করা। মানে, আমি ব্যস্ত। আজকাল সবাই মোবাইল ফোনসেটে ব্যস্ত থাকে। অবশ্য আমি এর মধ্যে খারাপকিছু দেখি না। কত অফুরান সময় কেটে যায় অনায়াসে। অবশ্য চাকরিজীবী মহিলাদের কথা আলাদা। যেহেতু আমি বেকার, মানে চাকরি করি না, সেহেতু আমার কাছে মোবাইল ফোন মানে ভালো থাকার বিষয়। তাছাড়া আমরা যারা গৃহিণী, তাদের জন্য মোবাইল ফোন তো আশীর্বাদ।

বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, অনেক কাজ থাকে ওদের নিয়ে। একটু একটু করে বড় হয়ে ওরা ওদের জগৎ তৈরি করে নেয়। ফলে গৃহিণী মায়েরা আরো বেকার হয়ে পড়ে। তখন মোবাইল ফোনই ভরসা। কোনো রান্না দেখতে হলে চাই মোবাইল ফোনসেট। কিছু জানতে হলে চাই মোবাইল ফোনসেট। মোট কথা, যাবতীয় প্রয়োজন মোবাইল ফোনসেটে। এই তো সেদিন কর্তার ওপর এত রাগ উঠেছিলো যে, নিজের রাগ কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। এমন সময় মোবাইল ফোনসেটটা নিয়ে এফবিতে ঢুকলাম। ওমা, সে কী, যা আসছে, সব রাগ রিলেটেড। ৩-৪টা ভিডিও দেখার পর রাগ যেন গলে ঠান্ডা পানি হয়ে গেছে। এর পরের বিষয়টা আরো মারাত্মক। হঠাৎ মাথায় এলো। আমি যে রাগ, এটা ফেইসবুক বুঝলো কিভাবে। তাছাড়া আমি তো কারো কাছে শেয়ার করিনি। তো… মারাত্মক ভয় পেলাম। রীতিমতো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। এরপর ফেইসবুকে ঢুকে দেখি, সব ভয়বিষয়ক বার্তা। ভয়ে তো দুই-তিন দিন ফেইসবুকে ঢুকিনি।

হঠাৎ বয়স্কা ভদ্রমহিলার কথায় মোবাইল ফোনসেটের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তাকালাম। কথা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু নয়, বরং একটু বেশিই জোরে বলে। বয়স হলে অনেকেই কানে কম শোনে। উনিও হয়তো কম শোনেন, তাই জোরে বলেন। হয়তো মনে মনে ভাবেন, জোরে না বললে তো শোনা যায় না। নিজেকে দিয়ে অন্যকে বিচার করা। একজন নার্স হুইলচেয়ার ঠেলে ওনাকে নিয়ে এলো। নার্স না কী, ঠিক জানি না। নার্স বলাটা মনে হয় ভুল হচ্ছে। আসলেই তো জানি না, তাদের কী বলে। অর্থাৎ, চোখের ডাক্তারের এখানে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে সহযোগিতা করে। ওদের কী বলে, জানি না। তবে ঐ যে সহজ চিন্তা, ডাক্তারের সাথে যারা থাকে, তারা নার্স। যাক, এই বিষয়টি সুযোগ পেলে জানতে হবে।

আমি যে চেয়ারটায় বসে আছি, তার সামনেই বৃদ্ধা মায়ের চেয়ারটা লক করে রাখা হলো। বয়স্কা মহিলার প্রশ্ন ছিলো, ‘ডাক্তার কী বলেছে, চোখ দিয়ে আর কাজ হবে না?’ নার্স বুঝিয়ে বলেছে, ‘মা, ডাক্তার বলেছে, আপনার চোখ ঠিক হয়ে যাবে।’ আবার জানতে চাইলো, ‘আর কখনোই ঠিক হবে না?’ জানতে চেয়ে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে দিলো। নার্স বারকয়েক জোরে জোরে বললো, তবুও শুনতে পেলেন না বৃদ্ধা মা। বুঝতে পারলাম, শুধু চোখ নয়, কর্ণযুগলও নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। ভাবনার ধূম্রজালে অন্যমনস্ক হয়ে আছেন মলিনমুখে। চোখে-মুখে অসংখ্য জিজ্ঞাসা। আমার চোখ কী বিস্ময়ে তাঁকে অবলোকন করছে, জানি না। পরনে একটা তাঁতের শাড়ি, গায়ে জড়ানো কফি কালারের একটা গরম চাদর। অনন্ত অপেক্ষায় অজানার উদ্দেশ্যে চেয়ে আছেন। ভাবতে অবাক লাগলো, এই বয়সে এসেও কতটা সচেতন, এখনো তিনি চোখ দিয়ে দেখতে চান। আর আমি জোরপূর্বক চোখকে অত্যাচার করেছি দেখার জন্য। এখন তো মনে হয়, দুই-তিন বছর যাবৎ এমন অত্যাচার করে চলেছি।

আমি বৃদ্ধার মুখপানে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরে নিজের আদল দেখতে পেলাম বৃদ্ধা মায়ের মুখচ্ছবিতে। মুখের গলার চামড়াগুলো এতটা কুঁচকে আছে যে, বোঝার উপায় নেই, কেমন ছিলো চেহারার আদল। তবে সচেতনতার অভাব ছিলো না বিন্দুমাত্র- এটা বুঝতে বোধ করি কারো খুব বেশি সময় নষ্ট হবে না তাঁকে দেখে। শাড়িটি পরেছেন পরিপাটি করে। বসার ভঙ্গিমা, কথা বলার ধরন- সবকিছু বলে দেয় তাঁর রুচির বিষয়।

তবে যেভাবে জোরে কথা বলছেন, আশপাশে সবাই বিরক্ত হয়ে বৃদ্ধার দিকে তাকাচ্ছে। আমারও অবশ্য প্রথম উচ্চৈঃস্বরে আওয়াজ শুনে চোখ পড়েছে, কিন্তু কেন যেন বিরক্ত লাগেনি। হতে পারে, নিজের অজান্তে বৃদ্ধার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করেছি।

নার্স অবশ্য বিরক্ত হয়ে একটু দূরে গিয়ে বসেছে, মানে বৃদ্ধার চোখের আড়ালে। এর মধ্যে ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে এলো ৪০-৪৫ বয়সী একজন মহিলা অথবা আমার বয়সী। বৃদ্ধা মা ভাবনার বেড়াজাল ডিঙিয়ে আশায় ঝলমল মুখে মহিলার কাছে জানতে চাইলেন, ‘ডাক্তার কী বললো, চোখ দিয়ে আর কাজ হবে না? কী বললো, বলছো না কেন।’ মহিলা অনেকক্ষণ চুপচাপ রইলো। শুনছে, কিন্তু কোনো কথা বলছে না। প্রশ্নের পর প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বসে রইলো। আবার বৃদ্ধা জানতে চাইলেন, ‘কী বলেছে ডাক্তার?’ মহিলা বললো, ‘অপারেশন লাগবে।’ তাদের আলাপচারিতায় মনে হলো, মেয়ে অথবা পুত্রবধূ। বৃদ্ধা মা আবারো জানতে চাইলেন, ‘কী বলেছে ডাক্তার, চোখ দিয়ে আর কাজ হবে না!’ আবারো মহিলা বললো, ‘হবে, কিন্তু অপারেশন লাগবে।’ খুব উৎফুল্ল হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কবে হবে অপারেশন? অপারেশন হলে সব দেখতে পাবো!’

ঠিক যেন ৬-৭ বছরের একটা বাচ্চা। মায়ের কাছে আবদার করছে তাকে খেলনা কিনে দিতে হবে। মা রাজি হলো দিতে। এখন বাচ্চার কৌতূহল, খেলনা কবে দেবে, কখন দেবে! বৃদ্ধা মা একবুক আশা নিয়ে মহিলার উত্তরের আশায় তাকিয়ে। মহিলা বললো, ‘দেরি হবে, চুপচাপ বসেন।’ বৃদ্ধা মা যেন এবার একটু হতাশ হলেন। নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন গালে হাত দিয়ে। হয়তো অনেক প্রশ্নের ভিড়ে প্রশ্নগুলো জট পাকাচ্ছে। হয়তো একটা নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানতে চাইছেন। হয়তো ‘দেরি হবে’ শুনে কিছুটা বিমর্ষ হয়েছেন। পুত্রবধূ হলে বাইরে বসে বিরক্ত হলেও ওভাবে প্রকাশ করতো না, মানুষ কী বলবে ভেবে। নিশ্চয়ই মেয়েই হবে। অভিনয় না করে সরাসরি বললো। তবু এমন বিরক্তিকর সুরে বলা কি ঠিক হলো!

আমিও তাকিয়ে আমাকে দেখছি। আমার আগামী ঐ বৃদ্ধা মায়ের মধ্যে। আমার চোখে এখন চশমা। প্রতিনিয়ত একটু একটু করে চোখের আলো ক্ষীণ হয়ে আসবে। চুলগুলো ঝলসে যাওয়া ধূসর রঙে, ইচ্ছামাফিক রঙে সাজবে। মুখের চামড়াগুলো লাবণ্য ও সতেজতা হারিয়ে নিদারুণ খসখসে হবে। কান দু’টি শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলবে। আচ্ছা, বৃদ্ধ হলে কি ভাবনাগুলো রং বদলায়? নিজের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস সব বাধা পেরিয়ে একঝটকায় বাইরে এলো।
বৃদ্ধা মা গালে হাত দিয়ে অজানা আশঙ্কায়, হাজারো প্রশ্নের সমারোহে বিষণ্ণ। একজন নার্স এসে চোখ বড় বড় করে ওপরের দিকে তাকাতে বললো। বৃদ্ধা মা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করবে মা।’ বললো, ‘ড্রপ দেবো।’ আবার জানতে চাইলো, ‘কেন ড্রপ দিচ্ছো?’ নার্স বললো, ‘আমি জানি না, ডাক্তার সাহেব দিতে বললেন।’ বলে ড্রপ দিয়ে চলে গেল।

ওদিকে একজন এসেছে বাচ্চা নিয়ে। বাচ্চা মানে, সাত-আট বছরের হবে। এখন ছোট ছোট বাচ্চার চোখেও চশমা। দুইজন মধ্যবয়সী বসে আছেন একপাশে। ভিডিওকলে দু’জন মিলে কথা বলছে, খুব আনন্দিত মনে কথা বলছে। দেখে মনে হয়, স্বামী-স্ত্রী। ছেলেমেয়ে হবে হয়তো তাদের সাথে কথা বলছে। দেখে মনে হয়, রুটিন চেকআপে এসেছে। যারা সচেতন, তারা প্রতি ছয় মাসে একবার অন্তত ডাক্তারের কাছে আসে চেকআপের জন্য। আচ্ছা এত সচেতন থেকেও জীবনের মেয়াদ কি বাড়ানো যায়! হয়তো যায় কিংবা যায় না। তাতে কী? সন্তানরা হয়তো বিদেশে বা প্রয়োজনে অন্য কোথাও থাকে। হয়তো তাদের কথা দেয়া হয়েছিলো ছয় মাসেই ডাক্তার দেখাবে, কিন্তু একমাস দেরি করে এসেছে। মনে হচ্ছে, গ্রুপকল করেছে। কথা রাখতে না পারার জন্য জন্য বিভিন্ন অজুহাত। আসলে সব প্রতিশ্রুতি কি সবসময় রাখা হয়, না রাখা যায়? তবু সবাই খোঁজ নিচ্ছে, অভিযোগ করছে। ফোন রেখে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। আত্মতৃপ্তি সবচেয়ে বড় সুখ।

তাদের হাসি দেখে আমারও ভালো লাগলো। অবশ্য আজ পর্যন্ত আমার জন্য আমার হাজব্যান্ড আমাকে নিয়ে কখনো ডাক্তারের কাছে আসেনি। এমনকি বাচ্চা হওয়ার সময় সবচেয়ে পাশে প্রয়োজন হাজব্যান্ডকে, তাও পাইনি। আক্ষেপ, অভিযোগ- কোনোটাই নেই, তবে অভিমান খুব বেশি গাঢ় হলে দীর্ঘশ্বাস তার প্রকাশ জানিয়ে দেয়। এখন তো দীর্ঘশ্বাসকে উপেক্ষা করতে শিখে গিয়েছি, তাই খুব একটা কষ্ট লাগে না বা একাকিত্ব পেয়ে বসে না।
একটু দূরে একজন পঞ্চান্ন-ষাট বছরের লোক। দেখতে খুব হ্যান্ডসাম, চুলগু-ে লা সাদা-কালো তবে মাথাভর্তি। এই চুলগুলোই তাকে আরো অসাধারণ করে তুলেছে। লাল একটা শার্টপরা, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, একা বসে আছে, তবে বিষণ্ণ। এজন্যই এমন একটা লালশার্ট পরেছে। অবশ্য লাল রঙে বেশ মানিয়েছে ভদ্রলোককে। হয়তো উনি ভীষণ একা, সেজন্যই বিমর্ষ লাগছে। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, হয়তো কেউ কথা দিয়েছিলো আসবে। সে হয়তো সময়ের প্রয়োজনে কথা রাখতে পারেনি। প্রতিশ্রুতি দেয়াটা যত সহজ, রক্ষা করা অনেক কঠিন থেকে। প্রয়োজনে সময়কে দোষারোপ করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়তো মন্দ নয়।

ধুৎ, আমিও তো একা এসেছি, তাহলে কি আমি একা! কাউকে দেখলে আমার অকর্মণ্য মস্তিষ্ক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলে। এটা আমার বাজে স্বভাব। আমার পরিবারে তো আপনজনের অভাব নেই, তবু যে একা এসেছি, হয়তো আমাকে দেখেও এভাবেই কেউ ভাবছে।

লিফট থেকে বেরিয়ে এলো সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চা, মায়ের কোলে। বয়স কত হবে? যেভাবে কোলে নেয়া, কত আর, ৫-৬ দিন বা সপ্তাহ। সাথে আছে অনেকজন- পাঁচজন, ছয়জন। না না, আরো আছে। অন্য লিফটে এসেছে আরো তিনজন। আহা, এতটুকু বাচ্চা, ওর কি চোখে সমস্যা? না হলে আসবেই বা কেন! সবাই ব্যস্ত নবজাতককে নিয়ে, মায়ের মনটা খারাপ।

মাথায় হাত বুলিয়ে কেউ একজন সান্ত্বনা দিচ্ছে, হতে পারে বর বা ভাই। বর ভাবি কেন! ভাববো না-ই বা কেন, আমার বর আসবে না বলে কারো বর যে আসবে না, এমনটা তো নয়। পৃথিবীটা ভীষণ বিচিত্র। পৃথিবীতে আসার সময় পাশে অনেক আপনজন থাকে, আর থাকে শেষ বিদায়ের সময়। মাঝখানের সময়গুলো এই যে আমার মতো একান্ত নিজের, আবার কখনো প্রয়োজনের। হয়তো এমনও হতে পারে, আমরা সম্পর্কের কাছে কোনোভাবে প্রতিশ্রু-ি তবদ্ধ, সেজন্য আমাদের থাকতেই হয়।

এককোণে দুইজন যুবত-যুবতী। মেয়েটির চোখে চশমা। হয়তো চোখ দেখানোর কিংবা মাথাব্যথার কথা বলে বাসা থেকে এসেছে। সাথের ছেলেটা অবশ্যই বয়ফ্রেন্ড। আলাপচারিতা কানে যা এলো, তা থেকে অন্যকিছু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। হয়তো কথা দেয়া ছিলো, আজ দেখা হবেই। তবে মান-অভিমান চলছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। চেয়ারের পাশে একগুচ্ছ দোলনচাঁপা। কথা শুনে মনে হলো, কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা নিয়ে এমন ঝামেলা হয়েছে। হয়তো ওরা দু’জনই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো, অন্য কারো দিকে কেউ তাকাবে না কখনোই, অন্য কারো সাথে কথা বলবে না কখনোই। আসলে এগুলো তো কথার কথা, ওরাও বুঝতে পারে, তবু ভালোবাসার মায়ায় এক অধিকার জন্ম নেয়, যে অধিকার থেকে ঝগড়া-খুনসুটি নিজে থেকেই পারমিশন নিয়ে নেয়। আমার একজোড়া চোখ আটকে আছে দোলনচাঁপার দিকে। বেলি, দোলনচাঁপা দূর থেকে দেখলেও ভালো লাগে। জীবনে কত সময় যে অপেক্ষা করেছি এমন একগোছা দোলনচাঁপা বা রজনীগন্ধা অথবা একমুঠো বেলির জন্য। প্রিয়জন কোনো বিশেষ দিনে হলেও আমার জন্য হাতে করে ফুল নিয়ে আসবে। হাঃ হাঃ, আসেনি। হয়তো কোনো প্রিয়জন জীবনে ছিলো না বা আসেনি। যদি কেউ থেকে থাকে, হয়তো প্রয়োজন অথবা বাস্তবতা। তবে গোলাপের ব্যাপারে আমি বরাবর লালগোলাপে মুগ্ধ।

স্মৃতি বড়ই আনমনে। ওদের দেখে নস্টালজিক হয়ে গেলাম মুহূর্তেই। মনে হলো, এই তো সেদিন, তবে হিসাব কষলে অনেক সময়। তখন কলেজে পড়তাম, আর এখন নিজের মেয়েই কলেজে পড়ে। তবে স্মৃতি যেন এতটুকু ধূসর হয়নি।

একদিন ডাক্তারের অজুহাতে এমনি করে বসে ছিলাম। বাসা থেকে বার বার ফোন দিচ্ছিলো, ডাক্তার দেখানো হয়েছে কিনা। বললাম, লম্বা সিরিয়াল! এভাবে অনেকটা সময়। কখন যেন আলাপচারিতায় শুরু হলো ঝগড়া। বিষয়টি মনে পড়তেই হেসে উঠলাম। সামনের চেয়ারে একটি মেয়ে বসা ছিলো। বার বার মনে হচ্ছিলো, ও ঐ মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে- এ নিয়ে সে কী তুমুল কাণ্ড। একমাস কথা বলিনি। এমন তো কথা ছিলো না। আজ আমার এখানে একা থাকারও কথা ছিলো না। কথাগুলো অন্যরকম থাকে, যা বাস্তবতাকে ছুঁতে পারে না। এসব ভাবনায় একা একা কেন যেন গোধূলিবেলার মতো বিষণ্ণ হয়ে গেলাম কোনো কারণ ছাড়াই।

দীর্ঘশ্বাস পুঁজি করে এযাবৎকাল যোগফল, গুণফল- সবই শূন্য এসেছে। তাই হিসাববিহীন স্রোতঃস্বিনী নদীর মতো বয়ে চলি। কখনো নিজের প্রয়োজনে অথবা অন্য কারো। কেবলই গতিপথের পরিবর্তন হয়, এই যা।
এর মধ্যে আমার ডাক এলো। ভেতরে চললাম। চোখ অমূল্য সম্পদ। এই চোখ দিয়ে ভালো-মন্দ সব দেখি, আলো-আঁধারের কত নিত্যনতুন খেলা দেখি। আর এই চোখ দু’টি দেখতে ডাক্তারের সময় লাগে না। বললো, ‘চোখ ভালো আছে।’ বললাম, ‘তাহলে যে কাছ থেকে আগের মতো দেখি না।’ ডাক্তার বললো, ‘কাছের মানুষগুলো তো সময়ের সাথে একটু দূরেই চলে যায়।

তাই দূরের জিনিস দেখা কি ভালো নয়?’
অসাধারণ একটা কথা। মনে ধরেছে।
আবার বললো, ‘খালি চোখে না দেখলে চশমা দিয়ে দেখবেন। সবকিছু যদি চশমা দিয়ে দেখা যেতো, অনেক স্পষ্টভাবে দেখা যেতো, যেটা খালি চোখে দেখতে পান না।’ কিছুটা বুঝলাম, কিছুটা বুঝতে চাইলাম না। সময়ের সাথে সাথে একটা বিষয় বুঝে গিয়েছি, সবকিছু জানতে হয় না, বুঝতে হয় না। ডাক্তার অনেকদিনের চেনা। তার না বলা কথাগুলো কিছুটা হলেও বুঝি তার চোখে তাকিয়ে। হাসি, দারুণভাবে টনিকের মতো কাজ করে। অনেক প্রশ্ন অথবা উত্তর, রাগ অথবা ক্ষোভ- অনেককিছুর সহজ সমাধান হয় হাসি দিয়ে। ডাক্তারের সৌজন্যে সেই হাসিটাই দিয়ে এলাম।

বের হয়ে দেখলাম, বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী যারা গল্প করছিলো, তারা চুপ হয়ে আছে।
একা মানুষটি খুব গম্ভীর হয়ে বসে আছে। যুবক-যুবতী এখন একজায়গায় বসে নেই; যোজন যোজন দূরে, একই ছাদের নিচে তবুও।

বাচ্চাটাকে সবাই ঘিরে আছে। কেউ আঙুল ধরতে চাইছে। কেউ বলছে, ‘দেখো, কী সুন্দর ঘুমায়।’ একজন বলছে, ‘দেখো, চোখ খুলেছে।’ কেউ বলছে, ‘দেখো দেখো, ঘুমের মধ্যে হাসে।’ মা কেবল বাবুটার মুখের দিকে তাকিয়ে আগামীর স্বপ্ন আঁকছে।

আরেকজন ২৪-২৫ বছরের ছেলে, হাতে সাদা ছড়ি। হয়তো জীবনের আলো খুঁজে পেতে চাইছে। নিয়তির নির্মমতা নিদারুণভাবে জীবনের রং বদলে দেয় কখনো ধূসর করে।
হয়তো সংসারের, নয়তো সন্তানের অথবা অতীতের স্মৃতি বা নিজেদের স্বপ্ন
অথবা প্রিয়জনের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের হাহাকারে লাগামহীন জটিলতার কিছু সময়ের বিরতি চলছে।
বৃদ্ধা মা একই জায়গায় বসে আছেন। কাছে গেলাম। হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, ‘মা, কেমন আছেন।’ নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন, ‘ভালো, তুমি কে, ডাক্তার?’ একটু এড়িয়ে গেলাম। বললাম, ‘এখন সমস্যা কী?’ বললেন, ‘চোখ কি ঠিক হবে, আমি কি আবার…?’

থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘মা, আপনি টেনশন করবেন না। ছোট্ট একটা অপারেশন হলে আপনি আবার দেখতে পাবেন।’ তিনি বললেন, ‘আগের মতো দেখতে পাবো?’ আমি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘আগের চেয়েও ভালো দেখবেন ইনশা আল্লাহ। আর চশমাও ব্যবহার করতে হবে না। ছোটবেলার মতো আপনি খালিচোখেই সবকিছু দেখতে পারবেন।’ বৃদ্ধা মা যেন আশার আলো পেলেন। মুখে অদ্ভুত হাসির ঝলক, যেন পৃথিবী হেসে উঠেছে। বললো, ‘মামণি, অপারেশন কি তুমি করবে।’ কী বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, ‘মা, আমার চেয়ে অনেক বড় ডাক্তার অপারেশন করবে আপনার। সেসব নিয়েই ভেতরে আলোচনা হচ্ছে।’ জানতে চাইলেন, ‘অপারেশনের দিন তুমি থাকবে তো!’ বললাম, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি আপনার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবো, তবে কথা বলবো না; সিনিয়র ডাক্তার থাকবে যে। আর মা, আপনিও আমাকে ডাকবেন না। তাহলে অপারেশনের কাজে ঝামেলা হবে। ১৫ মিনিট পরে আপনার অপারেশন শেষ হবে।’ মায়ের চোখে-মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো নতুন স্বপ্নের বিভোরতায়। মাথায় হাত বুলিয়ে মাথাটা আমার বুকে আগলে বললাম, ‘ভালো থাকবেন মা, আবার দেখা হবে।’ বৃদ্ধা মা হাতটা যেন ছাড়তেই চাইছিলেন না।

আমার সামান্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে যদি বৃদ্ধা মায়ের মনে এতটুকু প্রশান্তি আসে, যদি নতুন করে স্বপ্ন বোনেন, যদি বিশ্বাস করেন, ভালো থাকবেন, তাতে ক্ষতি কী। মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে সবাই যদি স্বপ্ন দেখে, একজন বৃদ্ধ মা স্বপ্ন দেখলে দোষের কী? বৃদ্ধা মায়ের ঐ হাসিমাখা মুখখানা এই মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি দামি। এমন মিথ্যা প্রতিশ্রুতির দায় আমি বার বার হাজারবার নিতে প্রস্তুত।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS