নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দুর্যোগ ঝুঁকির সামগ্রিক সংজ্ঞায়ন, সবুজ অর্থনীতিতে রুপান্তর ও ঝুঁকি প্রতিরোধে প্রকৃতিভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানালেন বিশেষজ্ঞরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এখন আর শুধু স্থানীয় বা আঞ্চলিক নয়, এর রূপ হতে হবে বৈশ্বিক।
৪ জুন, ২০২৪ প্রেসক্লাবে আয়োজিত Growing Disasters with Extreme Heat: Response and Resilience Perspective শীর্ষক আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন চেঞ্জ ইনিশিয়াটিভের প্রধান নির্বাহী ও পরিচালক মোঃ জাকির হোসেন খান, ‘উই মিন গ্রীণ’ এর সাধারণ সম্পাদক ফারহানা রহমান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট রফিকুল ইসলাম মন্টু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ জনাব গওহর নাঈম ওয়ারা, স্থপতি রফিক আজম, গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী এবং ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী মোস্তফা কামাল। আলোচনার আয়োজনে ছিল চেঞ্জ ইনিশিয়াটিভ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান উই মিন গ্রীণ এবং সচেতন ফাউন্ডেশন।
চেঞ্জ ইনিশিয়াটিভের প্রধান নির্বাহী ও পরিচালক মোঃ জাকির হোসেন খান তার বক্তব্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকৃতি গত ৫০ বছরে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বায়ুদূষণ, তীব্র দাবদাহ ও খরা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এখন শুধু স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, এর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। স্থানীয় পর্যায়ে সংস্কার প্রয়োজন দাবি করে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর পারস্পরিক বোঝাপড়া প্রয়োজন।
তিনি তার বক্তব্যে বলেন যে, দুর্যোগের কোন আন্তর্জাতিক সীমানা নেই। গঙ্গা নদীতে প্লাস্টিক দূষণ বা হিমালয়ের বরফ গলে পানি হয়ে যাওয়ার প্রভাব শুধু ভারত বা নেপালেই নয়, ভুগতে হবে বাংলাদেশকেও। তিনি বলেছেন, এ ধরণের দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে অনেক অদৃশ্য এবং নন-ইকোনমিক ক্ষতি হিসাবের আওতাধীন করা হয় নি। তিনি দুর্যোগ আইন ও বিধিমালাকে “জীবন্ত নথি”তে রূপান্তর করার দাবি জানান। কুড়িগ্রাম এবং সুনামগঞ্জে ১৩% মানুষ দুর্যোগ দ্বারা ক্ষতির ৩০-৫০% ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, ৪১% দুর্যোগ দ্বারা ক্ষতির ১০-৩০% এবং ৪৬% ক্ষতির ১০% এরও কম ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। তিনি আরো বলেন, দুর্যোগের ফলে যারা কর্মসংস্থান হারিয়েছে, তাদের জন্য “দুর্যোগ ভাতা” প্রবর্তন করার দাবি জানান।
আইপিসিসি এর ষষ্ঠ প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ধানের উৎপাদন কমে যাবে ২৫০%, অধিকন্তু সেচের খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা ধানের পরিবর্তে যব ও গমের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় ধানের চাহিদা মিটাতে হলে বাজেটের বেশ বড় একটি অংশ দান আমদানির পিছনে ব্যয় করতে হবে।
তিনি দুর্যোগের ভৌগোলিক চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, পদ্মার বামপাশে তাপদাহ বাড়ছে অর্থাৎ
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে জোয়ারের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক বিদ্যমান। বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণ
থেকে তিনি বলেন, জিডিপিতে দূষণের কারণের উদ্ভূত ক্ষতি হিসাব করা হচ্ছে না। তিনি এ ধরণের ক্ষতিকে
জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন। তিনি আরো বলেন, পরিবেশকে অবকাঠামোর তুলনায় অধিক প্রাধান্য দিয়ে অর্থনৈতিক মডেলের পরিবর্তন জরুরী, সেই সাথে রাষ্ট্রভিত্তিক পরিকল্পনার পরিবর্তে বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়াতে “সমন্বিত দুর্যোগ সাড়াদান বাহিনী” (জয়েন্ট ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স) গঠন করতে হবে। তিনি বলেন যে, এলাকাভিত্তিক দুর্যোগের ঝুঁকি অনুধাবন জরুরি এবং দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা স্থানীয় ভাষায় প্রাঞ্জল্ভাবে দিতে হবে। কমিউনিটি ভলান্টারিং কে উদ্যোক্তার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত বলে তিনি ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, দুর্যোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধকল্পে বৈদেশিক অর্থায়ন জরুরি, তবে তার ঋণ যেন গলগ্রহ না হয়ে দাঁড়ায় তাই তিনি ঋণের হার ১% এর বেশি না হয়, সেদিকে খেয়াল করা জরুরি। বিদেশী প্রকল্পের পরিবর্তে স্থানীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রকল্প নির্ধারণ করতে হবে।

সাম্প্রতিক রেমাল ঘুর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাংবাদিক ও কলামিস্ট রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, রেমাল ঘূর্ণিঝড়ের ফলে অনেক জায়গায় মাটি ধুয়ে চলে গেছে, অনেকের স্থাবর সম্পদ ভেসে চলে গেছে। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চল একটি গোল্ডেন চেইন, একে রক্ষা করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অধিকতর দুইটি ধাপ – প্রাক পূর্ব প্রস্তুতি ও দুর্যোগ পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী পুনরুদ্ধার সংযোজনের আহবান জানান।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ জনাব গওহর নাঈম ওয়ারা বলেন, দুর্যোগ পরবর্তী প্রশমনে নারীর জন্য অন্তর্ভুক্তিমুলক ব্যবস্থা থাকা জরুরি। বিশেষ করে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে নারীদের জন্য বিশেষ শৌচাগার স্থাপনের কথা ভাবা যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, পরিকল্পিত মনুষ্য সংশ্রব জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর হতে পারে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, সুন্দরবনের সুন্দরী গাছে আগাছার প্রাদুর্ভাবে আগামরা রোগ হয়, অথচ বাওয়ালিরা গোলপাতা কাটতে গিয়ে আগাছা কেটে দেয়, ফলে সুন্দরী গাছ রক্ষা পায়।
তিনি বলেন, সুন্দরবনের প্রায় ৮০টিরও অধিক পুকুর শুকিয়ে গেছে, এ কারণেই মিঠা পানির অভাবে বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে। তিনি বাঁধের মডেলের ব্যাপারে আরো সচেতন হবার পরামর্শ দিবেন। তাপপ্রবাহে জীবন ঝুঁকি হ্রাস্ক ল্পে মোস্তফা কামাল তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস ব্যবস্থা জোরদারকরণ ও পূর্বাভাস পাওয়া মাত্রই স্কুল কলেজ বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পরামর্শ দেন।
গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে রোগ সংক্রমণের হার বৃদ্ধি হয়। ক্ষতিকর পোষক বা ভেক্টরের জীবাণু পরিবহন ক্ষমতা অভিযোজিত হয়ে বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, কিছু জীবাণু তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অভিযোজিত হয়ে মানব শরীরে রোগব্যাধির সংক্রমণ করে। তিনি বলেন, দুর্যোগের মানসিক প্রভাব বিস্তর এবং তা নিয়ে গবেষণার দরকার রয়েছে।
দুর্যোগ প্রতিরোধকল্পে সবুজ অবকাঠামো নির্মাণের দাবি জানিয়ে স্থপতি রফিক আজম বলেন, ২৫০ মিমি বৃষ্টিপাতের ফলে ১ লক্ষ লিটার পানি ধারণ সম্ভব, উদাহরণ হিসেবে তার নকশা করা রসুলবাগের সবুজ নগরের উদাহরণ টেনে বলেন, উদ্ভাবন ও সবুজমুখী উন্নয়ন ছাড়া ঢাকা মহানগরের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস অসম্ভব।
1
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply