নিজস্ব প্রতিবেদকঃ পুঁজিবাজার বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভূতপূর্ব অবদান রাখছে। এই বাজারের সাথে প্রায় ৩৫ লাখ (পঁয়ত্রিশ) বিনিয়োগকারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৩ কোটি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে।
দেশের এমন কোন শিক্ষিত বেকার নেই, যে এই বাজারের সাথে সম্পৃক্ত নয়। আমাদের পুঁজিবাজারের সাথে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, ঘরের শিক্ষিত গৃহিনীও এ বাজারের সাথে জড়িত। যে বাজারের সাথে এত লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্য জড়িত- সেই বাজারকে যে কোন মূল্যে আমাদের সকলকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে উন্নয়নে কাজ করতেই হবে। দেশের সম্মানিত শিল্পপতিগণ পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে শিল্পের বিকাশ ঘটাচ্ছেন, বেকারত্ব লাঘব হচ্ছে, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে ও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।
এছাড়া, দেশের রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এর ফলে দেশের অর্থ বিভাগ দারুনভাবে সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র শেয়ারবাজার আজ চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে। বিনিয়োগকারীরা প্রতিনি নয়ত তাদের পুঁজি হারাচ্ছে। অনেক বিনিয়োগকারী ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বশান্ত হয়ে পথে বসেছে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান পর্ষদ দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের নানা আশ্বাস ও আহ্বানে নতুন করে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে।
কিন্তু অপরিপক্কতা ও দূরদর্শীতার অভাব, কিছু বিতর্কিত গোষ্ঠির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায়, বস্তা পঁচা কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিয়ে বাজার থেকে বেহিসাবি (বিশাল আকারের) অর্থ বের করে নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়া ইত্যাদি নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় আমরা বিনিয়োগকারীরা খুব অসহায় অবস্থায় রয়েছি।
ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স পুঁজিবাজারকে আরও সংকোচিত করবে…
বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার স্মরণ কালের সব থেকে খারাপ সময় অতিবাহিত করছে। দীর্ঘ ১৫ বছর পুঁজিবাজারে যে অনিয়ম হয়েছে তারই ফলাফল এখন ভোগ করছে দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
✔ তালিকাভুক্ত কোম্পানি গুলোর স্বেচ্ছাচারিতা।
✔ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অব্যবস্থাপনা।
✔ বন্ধ কোম্পানির ভুয়া কাগজ পত্র তৈরি করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা।
✔ সিন্ডিকেট করে প্লেসমেন্ট বানিজ্যের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া।
✔ বন্ধ কোম্পানির ডিরেক্টরা ভুয়া উচঝ এবং আকর্ষণীয় মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদের শেয়ার গুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধরিয়ে দিয়ে বাজার থেকে টাকা নিয়ে সটকে পড়া সহ নানা অনিয়ম এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। গত কয়েক মাসে প্রায় ৭০ হাজার বিও একাউন্ট থেকে সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে বিও একাউন্ট খালি করে দিয়েছে বিনিয়োগকারীরা।
উপরের কারন গুলো পুঁজিবাজারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। পুঁজিবাজারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি বর্তমানে যোগ হয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ।
* গত ২ বছরে দেশের ডলারের দাম বেড়ে গেছে ৪০ শতাংশের উপর।
* ব্যাংক গুলোতে বর্তমানে তারল্য সংকট প্রকট। কলমানি রেট কোন ভাবেই কমছে না।
* হুহু করে বাড়ছে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট। মুনাফা বেশি পাওয়া যাচ্ছে ট্রেজারি বিল-বন্ডে। দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে এখন সর্বোচ্চ সুদ।
* চার বছর পর সুদহার সীমা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ ও আমানতের সুদহার এখন থেকে নিজেরা ঠিক করবে।
* দেশের ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ১৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা মোট ঋণের ৯০ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।
প্রতিদিন পুঁজিবাজারে লেনদেন ও সূচক কমছে আর বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বাজারের এই ডাউন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে- যা বর্তমানে আরও বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে।
পুঁজিবাজারের এই দুঃসময়ে হাজারও সমস্যার মধ্যে এবার নুতন করে যোগ হয়েছে আরও ২টি সমস্যা।
১) ২.৫ শতাংশ বাড়তি করপোরেট করঃ ২০২৪/২৫ অর্থবছরে ২.৫ শতাংশ বাড়তি করপোরেট কর দিতে হতে পারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে। এতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি গুলোর আয় কমে যেতে পারে।
২) ব্যাক্তি বিনিয়োগকারীর উপর ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপঃ আগামী বাজেটে ব্যাক্তি বিনিয়োগকারীর উপর ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপ হতে যাচ্ছে (তবে, ক্যাপিটাল গেইন ৪০ লাখের কম হলে কর দিতে হবে না) এমন একটি নিউজ দেশের সকল জাতীয় পত্রিকায় এসেছে। বাস্তবেই যদি ব্যাক্তি বিনিয়োগকারীদের উপর এই মুহূর্তে গেইন ট্যাক্স আরোপ করা হয়- তবে বাজার দীর্ঘ মেয়াদের জন্য আকর্ষণ হারাবে। বর্তমানে অনেক বিনিয়োগকারীর অপ্রদর্শিত অর্থ রয়েছে পুঁজিবাজারে। শুধু তাই নয় পুঁজিবাজার নিচে চলে আসায় অনেক অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে ঢোকার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অবস্থায় যদি ব্যাক্তি বিনিয়োগকারীদের উপর গেইন ট্যাক্সের আরোপ করা হয় তবে ঐ টাকা গুলো হয়তো আর বাজারে আসবেনা। যা পুঁজিবাজারকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য মন্দা অবস্থার সৃষ্টি করবে।
পুঁজিবাজারের প্রতি বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে শুন্যের কোঠায়। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে সরকারকে। কলসির নিচে যদি ফুটা থাকে তাহলে পানি যতই ঢালেন কলসি ভরবে না। কলসের ফুটা বন্ধ করতে হবে। তেমনি পুঁজিবাজারের টাকা বের হয়ে যাওয়ার ছিদ্র গুলো বন্ধ করতে হবে তবেই বাজার দীর্ঘ মেয়াদে ভালো হবে।
কিন্তু এই পতনের ধারা থামিয়ে শেয়ারবাজারকে স্বাভাবিক তথা গতিশীল করা একেবারেই অসম্ভব কি? আমরা মনে করি সেইটা সম্ভব। আজ আমরা সেই কথা বলতেই আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের কয়েকটি প্রস্তাব আছে। “পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশন (ক্যাপমিনাফ)” বিনিয়োগকারীদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন। বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও কল্যাণের লক্ষ্যে বিভিন্ন অস্থিতিশীলতার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে উক্ত সংগঠন নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
তাই বর্তমান পুঁজিবাজারের মন্দা পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পুঁজিবাজার জননী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনায় নিন্মোক্ত ১২ দফা দাবি উত্থাপন করছি:
১। আসন্ন বাজেটে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে।
২। শেয়ারবাজার ভাল করতে আগামী এক বছর সকল ধরণের আইপিও অনুমোদন বন্ধ রাখতে হবে।
৩। বর্তমান নেতিবাচক পুঁজিবাজারে টেকনো ড্রাগস লি: এর আইপিও দ্রুত বন্ধ করতে হবে।
৪। ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপ বন্ধ করতে হবে।
৫। বাইব্যাক আইন কার্যকর করতে হবে।
৬। শেয়ার দর বৃদ্ধি পেলে যেমন কারণ দর্শানো হয়, তেমনি কমলেও যেন এর কারণ দর্শানোর নোটিশের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭। পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের ইস্যু দেখিয়ে যেসব কোম্পানির শেয়ার দর আকাশচুম্বী করা হয়েছে, সে সকল কোম্পানির শেয়ার কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৮। মিউচ্যুয়াল ফান্ড উন্নয়নে দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্বেও নো ডিভিডেন্ড দেয়া কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৯। ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড বাজার উন্নয়নে ব্যবহার করতে হবে।
১০। পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা ও সুরক্ষা তহবিল গঠন করতে হবে।
১১। স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুঁজিবাজার ও স্বচ্ছতা আনয়নে বিএসইসিতে বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
১২। আসন্ন বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ সম্পূর্ণ নিঃশর্তভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply