মোঃ আব্দুল্লাহ হক, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রতিনিধি: আলমডাঙ্গা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত রথতলার জোড়াকোঠা শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, এটি প্রায় শতবর্ষের এক সমৃদ্ধশালী ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। কালের বিবর্তনে জরাজীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই সুবিশাল দালানটি আজ তার অতীত ঐশ্বর্য হারালেও, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাডিয়া পরিবারের উত্থান ও স্থানীয় ক্ষমতার পালাবদলের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, তনসুক পাডিয়া এবং চুনিলাল পাডিয়া নামক দুই ভাই ভাগ্যান্বেষণে দিল্লীর নিকট প্লানি শহর থেকে প্রথমে তৎকালীন পাবনা জেলার বেড়া শহরে পাটের ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে সফল হতে না পেরে আনুমানিক ১৯২০ সালে তাঁরা আলমডাঙ্গায় আগমন করেন। বসবাসের জন্য দুই ভাই শহরের কেন্দ্র রথতলায় এই জোড়াকোঠাটি নির্মাণ করেন।
চুনিলাল পাডিয়া অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী ছিলেন এবং প্রচুর সম্পদের মালিক হন। যদিও তিনি তিনটি বিবাহ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। ফলস্বরূপ, তিনি প্রহ্লাদ পাডিয়াকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। চুনিলাল বাবুর মৃত্যুর পর এই বিপুল সম্পত্তির মালিকানা লাভ করেন প্রহ্লাদ বাবু।
প্রহ্লাদ পাডিয়ার বসতভিটা ছিল রথতলার পথে বামে অবস্থিত এই বিরাট জোড়া দোতলা দালান। এই পরিবারটি যে সে সময়ে সাধারণ ব্যবসায়ী ছিলেন না, তার প্রমাণ মেলে একটি লোককথায়। কথিত আছে, প্রহ্লাদ পাডিয়া তাঁর জোড়া দালান দুটিকে একটি ঝুলন্ত বারান্দা দিয়ে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন এলাকার প্রভাবশালী জমিদার মহাশয় ঘোড়ায় চড়িয়া যাওয়ার সুবিধার দোহাই দিয়ে সেই নির্মাণকাজে বাধা দেন। কিন্তু প্রহ্লাদ পাডিয়া সেই বাধা অগ্রাহ্য করে ঝুলন্ত বারান্দাটি নির্মাণ করেন। এই ঘটনা থেকে স্পষ্টতই অনুমেয় যে, সে সময়ে প্রহ্লাদ পাডিয়া যেকোনো জমিদারের তুলনায় বিশেষ ক্ষমতাধর এবং প্রভাবশালী ছিলেন।
প্রহ্লাদ পাডিয়া ছিলেন ৭ পুত্র ও ৪ কন্যার জনক। তাঁর মৃত্যুর পরও এই পরিবারের প্রতিপত্তি শেষ হয়নি। বর্তমানে তাঁর পুত্রদের মালিকানায় ভারতের কলকাতা, দিল্লী, বোম্বাই ও মাদ্রাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বিয়ারিং ফ্যাক্টরির মতো বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ী পরিবারটিও দেশত্যাগে বাধ্য হয়। প্রহ্লাদ পাডিয়া সপরিবারে ভারতের কৃষ্ণনগর হরিভগবান পাডিয়ার নিকট চলে যান। স্বাধীনতা লাভের পর তাঁরা বাংলাদেশে ফিরে এলেও আর বেশি দিন স্থায়ী হননি। ১৯৭৬ সালে ৫৭ বৎসর বয়সে তাঁর পরলোকগমনের আগে, তিনি তাঁর ব্যবসা ও মিল পরিচালনার দায়িত্ব জ্ঞাতিপুত্র পুরুষোত্তম পাডিয়া ও রাজারাম পাডিয়ার হাতে অর্পণ করে সপরিবারে স্থায়ীভাবে ভারতে চলে যান।
পাডিয়াদের নির্মিত এই ঐতিহাসিক জোড়াদোতলা দালানটি আজ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দীর্ঘকাল সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দালানটি এখন জীর্ণশীর্ণ। পথচারীরা যেকোনো সময় এটি মাথার ওপর ভেঙে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
আলমডাঙ্গার ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহনকারী এই ঐতিহাসিক দালানটি একটি মূল্যবান সম্পদ। এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে সংরক্ষণের জন্য দ্রুত কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই অঞ্চলের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে জানতে পারবে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply