বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:৫৫ অপরাহ্ন

হাইকোর্ট: দেশটা কি হরিলুটের জায়গা?

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, দেশটা কি হরিলুটের জায়গা? ছলে বলে কৌশলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে ঋণের টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এভাবে কি টাকা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে? আমরা কি এটা মেনে নিতে পারি?

‘জি বি হোসেন বনাম দুদক এবং অন্যান্য’ মামলার শুনানিতে সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ার) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন প্রশ্ন তোলেন।

জাহাজ ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন জি বি হোসেন নামে পরিচিত। তিনি কানাডারও নাগরিক। জাহাজ আমদানির কথা বলে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিলেন। দুদকের অভিযোগ, জাহাজ আমদানির নামে নেওয়া ঋণের পুরোটাই হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ২০১৯ সালে জি বি হোসেনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। সেই নিষেধাজ্ঞার আদেশ চ্যালেঞ্জ করে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের ওপর শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট তাকে বিদেশ যেতে অনুমতি দেন। পাশাপাশি রুলও জারি করেন।

এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে জারি করা রুলের বিষয়ে শুনানি চলছিল। ওই দিন একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘বিদেশে সম্পদ কেনার উৎসব’ শিরোনামে প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে তিন আইনজীবীর কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রাখেন হাইকোর্ট।

অন্য দেশের নাগরিকত্ব আছে এমন ব্যক্তি দেশের আয় দিয়ে ওই দেশে সম্পত্তি কিনতে পারেন কি না, তারা ব্যাংক ঋণ নিতে পারেন কি না, দ্বৈত নাগরিকদের বিষয়ে সংবিধান ও আইনে কি কি বাধ্যবাধকতা আছে।

এসব প্রশ্নে দুর্নীতি দমন কমিশেনর আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান, মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)-এর চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিকের বক্তব্য চাওয়া হয়। সে ধারাবাহিকতায় আজ বিষয়টি শুনানির জন্য উঠলে তিন আইনজীবীই আদালতে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন জি বি হোসেনের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল।

শুনানিতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, বিদেশে অর্থ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা নির্দেশনা আছে। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো দেশের পাঁচ বছরের ভিসা পান তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ ১২ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে যেতে পারবেন। আর এক বছর, ছয় মাস বা তার চেয়ে কম সময়ের জন্য ভিসা পেলে ১০ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। এছাড়া আর কোনো বৈধ উপায় নাই টাকা নিয়ে যাওয়ার।

দুদকের আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া হয়ে পরে এ টাকা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। হুন্ডির বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর এখন ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা আসছ। এই আসামিরও (জিবি হোসেন) দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে টাকা তিনি বিদেশে স্থানান্তর করেছেন।

এ বক্তব্য শুনে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি বলেন, এই দেশটা কি হরিলুটের জায়গা? উনি তো দ্বৈত নাগরিক। সে কি এভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে নিয়ে যেতে পারেন? দ্বৈত নাগরিকদের হার্ট (হৃদয়) তো দুই ভাগে বিভক্ত। কারণ তারা দুই দেশের নাগরিক। ঋণের টাকা বিদেশে নিয়ে গেলে সেটা এদেশে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও সে দেশে সেটা অপরাধ নাও হতে পারে।

তখন দুদকের আইনজীবী বলেন, একদম ঠিক, সেটাই হচ্ছে। তবে বিশ্বের কোেনা দেশই অনুমোদন দেয় না যে, যেভাবে পার দেশ থেকে টাকা নিয়ে আসো। গত এক বছরে কানাডাও তাদের আইনে পরিবর্তন এনেছে। ফলে এখন ইচ্ছেমেতা বাড়ি কেনা যাচ্ছে না সে দেশে।

তিনি বলেন, কুয়েতে বাংলাদেশের এমপি পাপুলের সাজা হয়েছে। কুয়েতি দূতাবাস এরপর অনেক কাজ করেছে এই ইস্যুতে। ফলে সে দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে অর্থ আসা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। গত বছর ওই দেশ দেশ থেকে সব টাকা এসেছে ব্যাংকিং চ্যানেলে।

এ পর্যায়ে অর্থপাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত ভারতের ‘রামজিৎ মালানি বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ মামলার রায়ের প্রসঙ্গ টেনে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, শুধু মামলা করে আর বক্তব্য দিয়ে কাজ হবে না। অর্থপাচার রোধ করতে নানা কৌশল গ্রহণ করতে হবে। যেমনটা ভারত সরকার করেছে। ওই দেশ যারা অর্থ পাচার করে সরকার সেই পাচারকৃত অর্থের ওপর ট্যাক্স কেটে নেয়। আপনি যদি কোনো দেশে পাচার করা টাকার পরিমাণ চিহ্নিত করতে পারেন তাহলে ওই টাকার ওপর ট্যাক্স আপনি পেতেন। ভারত পেরেছে। আমাদের দেশে এ নিয়ে কোনো আইন, বিধান নাই। আইন-বিধান করার কোনো উদ্যোগও দেখি না।

এ নিয়ে কাজ চলছে জানালে খুরশীদ আলম খানকে উদ্দেশ্য করে বিচারপতি বলেন, কতদিন ধরে কাজ চলবে। আমরা শুধু শুনেই যাচ্ছি কাজ চলছে।

মামলার বিষয়বস্তুর বাইরে জি বি হোসেনের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, শুধুমাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে বাধ্যবাধকতা আছে। সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে অন্য দেশের নাগরিকত্ব আছে এমন কোনো নাগরিক যদি আমাদের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান তবে তাকে সেই দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হবে।

এসময় তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের উদাহরণ টানেন। বিএনপির এই নেতা আমেরিকার নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।

এছাড়া সাবেক মন্ত্রী আবুল হাসনাতের দ্বৈত নাগরিত্ব ছিল বলে জানান আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।

এরপর নাগরিকত্ব, নাগরিকত্বের প্রকার, নাগরিকত্বের আইনি বিধি-বিধান, প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ১৯৮৪ সালের আগে বিয়ে করে ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকত্ব লাভ করার প্রচলন ছিল। ১৯৮৪ সালের পর অনেক দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ মেলে। তখন থেকেই দেশের টাকা পাচার বা স্থানান্তরের প্রবণতাটা বাড়তে থাকে।

আর রাজনৈতিক বিবেচনায় যখন ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ হচ্ছে তখন থেকে লুটপাট শুরু হয়েছে। আর এই লুটপাটের টাকা দিয়েই বিদেশে কেউ বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব অর্জন করছেন। বাড়ি কিনছেন। আদালত এ বিষয়ে একটি স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করতে পারেন।

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তখন বলেন, ঋণ আবেদনের সময় দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টি উল্লেখ থাকা দরকার। দ্বৈত নাগরিক হলেও ঋণ নিতে আইনগত কোনো বাধা তো নাই।

এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, বেসিক ব্যাংকের অর্থ বিদেশে পাচার নিয়ে ওই ব্যাংকের বক্তব্য শোনা উচিত আদালতের। কেন তারা একজন দ্বৈত নাগরিককে এত টাকা ঋণ দিলো? এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও বক্তব্য আদালত শুনতে পারেন।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টি স্পর্শকাতর উল্লেখ করে আদালতের আদেশের আগে এ নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত বলে মত দেন। পরে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য শোনার জন্য আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী দিন ঠিক করে সে পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।

Please Share This Post in Your Social Media

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS