শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৮ পূর্বাহ্ন

হিজড়া শৈশব এক বিভীষিকার নাম

মো. নাঈম ইসলাম
  • আপডেট : মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
  • ১৯৯১ Time View

বগুড়া থেকেঃ

বিকাশ প্রকাশ আর নানা অপূর্ণতার কারণে ত্রুটিপূর্ণ লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নেয়া একটি শিশু পরিণত বয়সে সমাজে পরিচিতি পায় হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে। সমাজে চলতে-ফিরতে সব মহলে তাকে হতে হয় অবজ্ঞা অবহেলার শিকার। এক পর্যায়ে স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়তে হয় তাকে। দিনশেষে জায়গা মিলে ভাগ্যবিড়ম্বিত হিজড়া জনগোষ্ঠীর কাতারে। নিজস্ব হাবভাবের জন্য অনেক সময় সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব এমনকি বাড়ির আত্মীয়দের কাছেও বিদ্রুপের পাত্র হয় এরা। 

বগুড়ার তৃতীয় লিঙ্গের একজন অর্জুন (১৫)। পড়ে বগুড়ার জামুর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে। এবারের গৃহগণনা ও জনশুমারিতে হিজড়া লিঙ্গে গণনা হয়েছে সে। শিশু বয়সে তার মধ্যে যখন মেয়েলি ভাব দেখা দেয়, তখন আশপাশের লোকজন তার পরিবারের সদস্যদের কটূ কথা বলত। অন্যের সন্তানের সাথে মিশলে তারা খারাপ হবে এই ভেবে বাধ্য হয়ে মিশতে দিতো না কারো সাথে। একপ্রকার সঙ্গীহীন, ঘর বন্দিজীবন তার। প্রতিবেশীদের এমন কথায় মা রাতে নীরবে কাঁদতেন। অর্জুনের ভাষায় ‘প্রথমে বুঝতাম না। যখন কিছুটা বুঝতে শিখেছি, তখন বুঝতে বাকি ছিল না যে, মা আমার জন্যই কাঁদেন। ‘  

বগুড়ার শেরপুরের মো. সানি’র গল্প ঠিক এমনই। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় তীব্র বুলিংয়ের শিকার হয় সে। সে সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। দুই বছরের বেশি সময় স্কুল থেকে বাহিরে ছিল সে। বর্তমানে সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। এখন সমাজসেবার আওতায় হিজড়া শিক্ষার্থী হিসাবে উপবৃত্তির উপকারভোগী সে। সানি জানায়, ‘এখন বাসায় থেকে পড়াশোনা করছি। মা সহযোগিতা করে ও সাহস দেন। যদিও পরিবারের আর সবাই নানান বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে থাকে সবসময়ই। কোথাও বিয়ে হলে সেখানে তাদের সাথে নিতে চায় না। নিলেও চুপচাপ থাকাতে বলে। যদিও নাচ আমার ভালো লাগে। একবার নাচছিলাম পরে ভাই বাড়ি এসে চড় মারছিল। ‘ 

প্রতিবেদনের জন্য আরো কয়েকজন হিজড়া শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলতে বগুড়া জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ফোন নম্বর ও ঠিকানা নিয়ে সরাসরি কথা হয় তাদের সাথে। 

তাদের মধ্যে কুতুব একজন। কুতুব বগুড়ার সদরের এক বেসরকারি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট থেকেই কথায় আর চলনে আলাদা বলে ‘মাইগ্যা’ বলে সমন্ধোন করে ডাকা হয় হরহামেশাই। এমনকি স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচ-গান করার কারনে বন্ধুরা ‘হাফ লেডিস’ বলে থাকে। এছাড়া খাতা-বইয়ে ‘মাইগ্যা কুতুবু আফা’ লিখে রাখে। 

অন্য শিশুরা তার সঙ্গে মিশলে ‘নষ্ট’ হয়ে যাবে বলে তাকে স্কুলে ভর্তির সুযোগ দিতে রাজি হননি সদরের এক স্কুলের শিক্ষক। 

কুতুব জানায়, ‘মানুষ তো আমি! কারো থেকে তো কিছু চাই না; সাহায্য চাই না! শুধু মিশতে চাই। তাও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। বলে তোর সখীদের সাথে আড্ডা দে, যা! কোন কোন স্যারও নানাভাবে আকার ইঙ্গিতে কথা বলে, মনে হয় আমি মানুষ না। আমার মন নাই।’ 

বাংলা একাডেমীর সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান বলছে, ‘হিজড়া’ শব্দটি হিন্দি ভাষা থেকে এসেছে। তবে হিজড়া বিষয়ক গবেষকদের মতে, হিজড়া শব্দটি এসেছে ফার্সি থেকে। ফার্সি ভাষায় হিজড়া অর্থ হলো- ‘সম্মানিত ব্যক্তি।’ অথচ সমাজে গালি আর ট্যাবু হিসেবে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়। 

শৈশবের বিভীষিকার গল্প-

২৩ বছর বয়সী পপী হিজড়া (পিয়াস)। থাকে বগুড়ার সদরের কামারগারি এলাকায়। ছোট বেলার গল্প শুনতে চাইলে দুঃখ করে বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বাবা মায়ের সাথে থাকার আক্ষেপ জানান। বাবা মাকে দেখেন না গত দুই বছর হচ্ছে। স্মৃতি চারণে পপী জানায়, ‘বাবার সঙ্গে বাজারে গেলে সবাই তাকিয়ে থাকত, আজেবাজে কথা বলত। ভাই-বোনদের মধ্যে কিছু হলে আমাকেই দোষারোপ করত। তারাও মনে আঘাত দিয়ে কথা বলত। এক পর্যায়ে নিজেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। তখন আমার বয়স ১৩ কি ১৪ বছর। কোথায় যাব? কি করব? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে বগুড়া শহরে এক গুরু মা’র  কাছে । সেখানেও শান্তি মেলেনি। এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা হলে বলত- কি রে, এখনও মরিস নি? দুই বছর পর সিরাজগঞ্জে আরেক গুরু মা’র কাছে চলে যাই। ছোট ছিলাম বলে প্রথমে কোন কাজ দিতো না। থালা-বাসন, জামা-কাপড় ধোয়া, বাজার করা ও ঘর পরিষ্কারের কাজ করতাম। গুরু মা নাচ-গান, হাততালি, কড়া লিপস্টিক লাগানো, ঢোল বাজানো শেখাতেন। এভাবে গুরু মা’র কাছ থেকে শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে ‘হিজড়াগিরিতে’ নেমে গেছি। এখন আবার বগুড়ায় আসছি পূর্বসাথীদের সাথে থাকছি। এ জীবন কষ্টের ! ‘ 

যে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা থেকে রেহাই পেতে এবং একটু সুখের আশায় রিনা (১৭) হিজড়া নীড় ছেড়ে হিজড়াগিরি খাতায় নাম লিখেছিলেন, সেই সুখ পাখি তো ধরা দিলোই না বরং রিনার জীবনে নামে কঠিন সময়। রিনা যখন রাজপথে হেঁটে হেঁটে টাকা কালেকশন করেন, অনেকেই তাকে মারতে চায়, টাকা ছিনিয়ে নিতে চায়, খারাপ প্রস্তাব দিতো, হাত ধরে টানাটানি করতো। এখন পড়াশোনা করলেও তার ধারণা ভাইভা’তেই বাদ পড়বে সে। তিনি বলেন, ‘ আমি তো ওদের চোখে হিজড়া। আমি যতোই পড়াশোনা করি না কেন আমাকে দেখলেই বাদ দেয়া হবে। লোকে বলে হিজড়াদের এতো পড়ে কি হবে?  তবুও পড়ি। আমার বিশ্বাস নিজেদের অধিকারের কথা বলতে হলে শিক্ষিত হতে হবে।’ 

পাঁচ-ছয় বছরেই ট্রোলের শিকার হন রানা ওরফে রানী। ট্রোল, বুলিং–এ শিকার হওয়া গল্পে ভরা তার পুরো শৈশব-কৈশোর। ওই সময় জীবনের কাছ থেকে এতটা বৈরীতা তিনি পেয়েছেন যে আর কখনোই তিনি স্বপ্নেও শৈশবে ফিরতে চান না। শৈশব তার কাছে এক বিভীষিকার নাম! 

হিজড়া সন্তান নিয়ে মা-বাবা কি বলছে? 

নানানভাবে অবজ্ঞা অবহেলার শিকার হিজড়া জনগোষ্ঠীর পাঁচ থেকে সাত জনের মা-বাবার সঙ্গে কথা হয়।  

হিজড়া কুতুবের মা কাজলি বেগমের জানান, ‘মানসে (মানুষ) কয় আমি পাপ করছি সেজন্য আল্লাহ এরকম ছোল (সন্তান) দিছে। কিন্তু ছোল তো আমার ! মানুসে কয় আর বুকে কষ্ট নিয়ে থাকি। কি করমু বাবা! বাড়িত’ও অশান্তি। কোন কিছু হলেই সব দোষ আমার এই ছোলকে দেয়।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন অভিভাবক জানান, ‘আমার ছেলে আমার মেয়ের জিনিসপত্র নিয়ে সাজুগুজু করে। মেয়ে চিল্লাচিল্লি করে। খাবার বসেও ছোলডাক কথা শুনায় বাড়ির সবাই। খাবার বসেও চোখ দিয়ে পানি পড়ে। লোকে বলে হবার পর লবন খিলে মেরে ফেলতে পারিস নি! ’

সোহাগ হিজড়ার মা সেফালি জানায় ‘যে সন্তান বাড়ির জন্য মঙ্গল সেই সন্তানই আজ আমার সবার কাছে অমঙ্গলের ছায়া। সবাই বলে মরিস না! মা বেটা মরে যা ! একসাথে কোথাও গেলে লোকজন চেয়ে থাকতো। মনে হয়, আমরা মা-ব্যাটা বাঘ-ভাল্লুক। হিজড়া সন্তান হইছে মায়ের দোষে, পাড়াপ্রতিবেশি বলতো। এসব শুনে আমার সেই সন্তান বাড়ি ছাড়া। মাঝেমধ্যে ফোন করে কিন্তু দেখতে পারি না।’ 

এছাড়া তাদের বাবার সাথে কথা বলতে গেলে সোহাগ হিজড়ার বাবার পরিচয়ে কথা বলতে সম্মতির বিপরীতে অস্বীকৃতি জানান তার সন্তান নয় বলে। যদিও আর দু’একজন বাবার দাবি ‘আল্লাহ’ই দিছে!’ বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। 

সমাজের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হিজড়া শৈশবেই-

বৈষম্যের শিকার হওয়া তৃতীয় লিঙ্গের শিকলে বাঁধা থাকে সবকিছু। সবক্ষেত্রেই বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী। তবে উল্লেখযোগ্যভাবে বৈষম্য পরিবারে, সমাজে, বৃহত্তর শিক্ষা ক্ষেত্রে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে, ধর্মের দৃষ্টিতে, সামাজিক প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, মিডিয়ায় নেতিবাচক উপস্থাপনে, সম্পদ বন্টনে ইত্যাদি।

একজন হিজড়া শিশুর যে প্রাপ্য অধিকার তা  পরিবার থেকেই কেড়ে নেয়া হয়। অনেকেই আপত্তি জানালেও বাস্তবতা হচ্ছে, প্রথম বিধিনিষেধ আসে খোদ পরিবার থেকেই। হিজড়া শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। 

জানা যায়, বাকস্বাধীনতা থেকে শুরু করে সর্বস্তরেরই হস্তক্ষেপ করা হয়। অভিযোগ আছে, এসডিজিতেও আসে নি এই জনগোষ্ঠীর নাম। জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে নেয়া হয় না তাদের পরামর্শ। 

এসডিজিতে কেন নেই হিজড়াদের কথা? 

বলা হচ্ছে, এযাবৎকালের সবচেয়ে নিখুঁত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত হয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)। বিপত্তির বিষয় হলো, এসডিজি’তে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য কিছুই বলা হয় নি। 

যার ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে লিঙ্গ সমতাসংক্রান্ত লক্ষ্য এসডিজি-৫ এর মূল বক্তব্য হচ্ছে, ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন করা এবং সকল নারী ও কন্যাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা’। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এসডিজি-৫ এর ৯টি টার্গেট এবং ১৪টি ইন্ডিকেটরের কোথাও ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। অথচ এসডিজির মূল স্লোগান হচ্ছে ‘কেউ বাদ যাবে না’।

কি বলছে পরিসংখ্যান? 

বগুড়ায় সরকারিভাবে গঠিত হিজড়া সনাক্তকরণ কমিটি জরিপ চালিয়ে বিভিন্ন বয়সের ৪৭৮জন হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৭১ শতাংশ বা ২৫২জনই বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী। বাকি ২২৬জন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সমাজ সেবা অধিদফতরের জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বগুড়ায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য এইডস্ প্রতিরোধ কার্যক্রম বিষয়ক এক সভায় সমাজসেবা অধিদফতরের বগুড়ার সহকারি পরিচালক আতাউর রহমান ওই জারিপের ফলাফল তুলে ধরেন। 

এছাড়া আরো এর বাইরে জেলার স্কুলগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে আরও ২৪০ জন হিজড়া শিক্ষার্থীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে তারা নিজেদেরকে হিজড়া পরিচয়ে পরিচিত করতে চায় বলে তাদের নাম নিবন্ধন করা হয়নি। 

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট বলছে গোটা দেশে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে নিবন্ধিত ভাতাভোগী হিজড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২২৫ জন। 

জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সালের প্রাথমিক ফলাফল বলছে, দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী আছে ১২ হাজার ৬২৯ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে সরকার দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ‘হিজড়া’ লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বীকৃতি দেয়। 

পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর জন্য বেসরকারি সংগঠনের ভূমিকা কি-

মানুষ হিসেবে তাদেরও যে অধিকার রয়েছে, তা সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে হিজড়াদের উন্নয়নে হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন খুব ছোট্ট পরিসরে হলেও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরমধ্যে বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, সুস্থ জীবন, বাঁধন হিজড়া সংঘ, লাইট হাউস, দিনের আলো ইত্যাদি সংগঠনের নাম কম-বেশি শোনা যায়। এদের কার্যক্রম ততোটা জোড়ালো না হলেও এইডস প্রতিরোধসহ কিছু উন্নয়ন কার্যক্রমে এরা যুক্ত রয়েছে বলে জানা যায়। সেখানে রাষ্ট্রের তেমন কোন অনুদান নেই। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে হিজড়াদের কেউ কেউ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে যাচ্ছে। 

কথা হয় লাইট হাউজ বগুড়ার কার্যালয়ের প্রধান নির্বাহী মো. হারুন অর রশিদ’র সাথে। তিনি জানান, ‘আমরা হিজড়াদের নিয়ে বৃহত্তর পর্যায়ে কাজ করতে পারি না। সমাজসেবার সহযোগিতায় যতটুকু দরকার করি কিন্তু তাদের জীবন মান উন্নয়ন না, তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে উত্তরণ  করার কিছু কাজ আমরা করে থাকি। বিশেষ করে এইডস্ বিষয়ক বিষয় নিয়ে আমারা সহযোগীতা করে থাকি। তবে যতদূর সম্ভব আমরা করি। আরো দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।’ 

নিপীড়ন, বুলিংয়ের অভিযোগ হেলাফেলা- 

হিজড়া শিশুদের ছোট থেকেই নানান নামে ডাকা হয়। এছাড়া চলতে-ফিরতে, কথা-বার্তায় এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়তেও নানান প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়। নানান সমস্যার কারনে মানসিকতার বির্পযয় ঘটে। এছাড়া চারদিকে ‘না, না, না’ শুনতে শুনতে তারা নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। এছাড়া ট্রোল আর বুলিং এ শৈশব হয়ে উঠে অতিষ্ঠ। 

পত্রিকার শিরোনাম না হলেও একাধিক হিজড়া  অভিযোগ করে বলে, তাঁদের লাঠি দিয়েও ধর্ষণের অভিযোগ আছে , এছাড়া এমন স্বভাবের জন্য কুপ্রস্তাব সহ বাজে অকথ্য ভাষা ছুড়ে দেয়। কিন্তু পুলিশ সেসব অভিযোগ গ্রহণ করে না। কেননা, আইন অনুযায়ী, এটা ধর্ষণ নয়। যদিও বিস্তার অভিযোগ আছে, হিজড়ারাই মানুষদের হেনস্তা করে থাকে। 

জিম (ছদ্মনাম) নামের এক তৃতীয় লিঙ্গের কিশোর জানায়, তার সঙ্গে জোরপূর্বক অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায় তারই গ্রামের অনার্স পড়ুয়া এক বড় ভাই। যদিও সে সময় আপত্তি জানালেও রক্ষা হয় নি তার ইচ্ছের। এরপর নানাভাবে ভয় দেখিয়ে বারবার তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য হয় এই কিশোর। 

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের মনোবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. শরিফ রায়হান জানান, ‘এতে করে এই হিজড়া শিশুদের মানুষিকভাবে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে। একসময় নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ৫ জনে ১ জন মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এখন আসা যাক মানসিক সমস্যা বলতে কি বোঝায় যা অনেকেই জানেন না। জানলেও তা প্রকাশ করেন না। যদি কারও চিন্তার পরিবতর্ন, আবেগের পরিবতর্ন, স্মৃতিশক্তির পরিবতর্ন, বিচার বিবেচনার পরিবতর্ন, যা ব্যক্তির নিজের এবং অন্য মানুষের ক্ষতির কারণ। যদি লক্ষণগুলো টানা কয়েক সপ্তাহ বা মাস থাকে তবেই বুঝতে হবে তার কোনো না কোনো মানসিক সমস্যা আছে। হিজড়া তো স্রোতের বিপরীতে চলে সমাজে। সুতরাং তাদের চ্যালেঞ্জ বেশি। অনেক সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সমস্যা বড় আকার ধারন করতে পারে।’ 

তিনি আরো জানান, ‘আমরা গবেষণার ফলাফলে দেখেছি মানুষের নেতিবাচক কথা আর অবহেলার ফলে মানসিক ও স্বাস্থ্যগত বিষয় উভয়ই অনুকূলে আসে না, বরং হিতের বিপরীতে চলে যায়।’ 

আইনে কি বলে-

বাংলাদেশে পারিবারিক সম্পত্তির ভাগাভাগির ক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্মের আইন ব্যবহার হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে সম্পত্তি ভাগাভাগি হয় মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের আওতায়। ১৯৬১ সালের মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে। সেই আইনে হিজড়াদের সম্পত্তির ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সন্তানদের কথা বলা হয়েছে। সন্তান মানে পুত্র এবং কন্যারা সম্পত্তির ভাগ পাবেন। বাংলাদেশে বিদ্যমান এই আইনে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে বলা নাই।

আর বাংলাদেশে হিন্দু আইনে ওই ধর্মাবলম্বীদের জন্য সম্পত্তির ভাগাভাগি যেভাবে হয়, তাতে কন্যা সন্তানরা বিয়ের পর বাবার সম্পত্তির ভাগ পান না। সেখানে হিজড়াদের ব্যাপারে কিছুই বলা নাই। তাই বিষয়টি নিয়ে  আলোচনার প্রয়োজন বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

যদিও ২০২০ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী হিজড়াদের সম্পত্তি পাওয়ার কথা বলেছিলেন। হিজড়া সম্প্রদায় যাতে বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে সমান ভাগ পায় এবং পরিবারে থাকতে পারে তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। 

ধর্মের দোহায় দিয়ে অনুভূতিতে আঘাত –

এনটিভির ইসলামিক অনুষ্ঠান ‘ আপনার জিজ্ঞাসা ‘ অনুষ্ঠানে ঢাকার নূরমহল নামক এক নারী জানতে চেয়েছিলেন, কোরআন-হাদিসে হিজড়াদের নিয়ে কোনো কথা আছে কি? উত্তরে আলোচক আলেম ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন,’ ইসলাম হিজড়া বলতে কোনো জিনিস আবিষ্কার করেনি। এরা তৃতীয় লিঙ্গ বা চতুর্থ লিঙ্গ ব্যাপারটি এমন না, একেবারেই ভুল কথা। এদের ইসলাম মানবসন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং মানবসন্তানদের মধ্য থেকে তাদের বিধান দেওয়া রয়েছে ইসলামে। এ ব্যাপারে একেবারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। যাদের ইসলামের জ্ঞান নেই, তারা হয়তো বলতে পারবে না।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান না রাখার কারণে আমরা এদেরকে ভিন্ন একটি লিঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছি, তাদের ভিন্ন সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছি, এমনকি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক যেই অধিকার রয়েছে, সেগুলো থেকে তাদের বঞ্চিত করছি। এটি একেবারেই ভুল কাজ, ইসলাম এটা মোটেও স্বীকার করে না। ইসলাম তাদের মানবিক জীবন এবং মানবসন্তান হিসেবে যেভাবে জীবনযাপন করার বিধান রয়েছে, সেভাবে জীবনযাপনের বিধান দিয়েছে। সম্পত্তিসহ সব ক্ষেত্রে তাদের অধিকার রয়েছে। কোনোভাবেই ইসলামে তাদের অবহেলা করা হয়নি।’

কিন্তু সমাজে অনেকেই দাবি করে বসেন, বাবা-মায়ের পাপের ফসল হিজড়া সন্তান। এছাড়া ইসলাম বিরোধীদের এমন সন্তান হয় বলেও অনেকের কুসংস্কার আছে। হিজড়ারা মারা গেলে জানাজার নামাজও না পড়ানোর অনিহা দেখা দেয় মৌলবিদের মধ্যে। যদিও এগুলো ইসলাম সমর্থন করে না বলে জানান এই আলোচক। 

হিজড়া শিশুদের ভবিষ্যৎ কি ম্লান- 

২০২০ সালের জুলাই মাসে ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিইং বাংলাদেশ হিজড়া ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি বা কর্মসংস্থানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং তাদের জীবন মান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে জানা গেছে, হিজড়াদের মাঝে ৬৮ শতাংশ কর্মদক্ষ এবং অভিজ্ঞতা থাকলেও ৬২ শতাংশ কোনো ধরনের সুবিধাই পান না। ফলে ভিক্ষাবৃত্তির সাথে সম্পৃক্ত ৮৩ শতাংশ। 

২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর ‘হিজড়া অধিকার’ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে -‘দৈনিক জনকণ্ঠ’। সেখানে বলা হয়, জন্মগত ছাড়াও লিঙ্গ পরিবর্তনকারীকেও হিজড়া হিসেবে গণ্য করতে হবে, স্বয়ং সরকারি সংস্থা এমনটি বললেও কেবল ‘হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের’ সংজ্ঞার কারণে সরকারি ৩ সংস্থায় চাকরি হয়নি অর্ধশতাধিক হিজড়ার। জানা যায়, তারানা হালিম ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালীন ১০ জন হিজড়াকে মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী হিজড়াদের অনেকে চাকরির আবেদনও করেন। সবকিছু শেষে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হিজড়াদের নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ডাক্তারি পরীক্ষায় ১০ জনকে নকল হিজড়া বলে গণ্য করা হয়। তাই তাদের আর চাকরি হয়নি। যদিও তারা সরকারি খাতায় হিজড়া হিসেবে নথিভুক্ত ছিল। 

হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা খোদ সমাজসেবা অধিদফতরেও চাকরি হয়নি ১২ জন হিজড়ার। ২০১৪ সালে অধিদফতরের অধীনে ছোটমনি নিবাসে শিশুদের দেখাশোনা ও রান্না-বান্না করার জন্য ১২ জন হিজড়া নেয়া হবে বলে অধিদফতর ঘোষণা দেয়। সেই আলোকে বেশ কয়েকজন হিজড়া আবেদনও করেন। সমাজসেবা অধিদফতরের বেদে, অনগ্রসর ও হিজড়া জনগোষ্ঠী শাখায় উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তখন চিকিৎসক যাদের হিজড়া বলেছে, আমরা তাকেই হিজড়া হিসেবে নিয়েছি। রক্ত পরীক্ষা করলে পুরুষ চলে আসে, পুরুষ হিসেবে দেখাচ্ছিল। শরীরে হরমোন কম-বেশি থাকলেও এটা আসে। তখন তেমনটিই হয়েছিল। 

ওই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে খবরে আরো বলা হয়,  এখন মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। তাই হিজড়া শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে শারীরিক গঠন ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছে সরকার। যেহেতু একজন মানুষের লিঙ্গ থাকলেও তিনি শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকে দিয়ে হিজড়া, সেহেতু নকল হিজড়া বলতে কোন কিছু নেই বলে মনে করছে সমাজসেবা অধিদফতর। 

এসব দিক বিবেচনায় হিজড়া শিশুদের ভবিষ্যৎ কি? হিজড়া শিশু বড় হয়ে কি পরম্পরায় অন্য হিজড়াদের মতো রাস্তায় ও ঘরে অন্যের নিকট হাত পাতবে? সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করার কি অধিকার পাবে না? 

এসব বিষয়ে মত দেন সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক মুহম্মদ এনামুল বারী। তিনি বলেন, ‘ সরকার তাদের বিষয় যথেষ্ট কাজ করছে। পাশাপাশি বেসরকারি কতিপয় সংস্থাও কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি-বেসকারিভাবে শুধু এগোলে হবে না। সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। সমতার সমাজ দরকার। বৈষম্যের সমাজে সমৃদ্ধি হবে না। রক্ষণশীল সমাজের মূলধারায় এই হিজড়া শিশুদের জায়গা দিতে হবে।’ 

আন্তর্জাতিক সংস্থা কি বলছে? 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, হিজড়াদের বিষয়টি এখন থেকে আর ‘মানসিক বা আচরণগত ব্যাধি’ হিসেবে দেখা হবে না।

২০২২ সালে জাতিসংঘ স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থাটি এই লিঙ্গগত ইস্যুগুলোকে ‘যৌন স্বাস্থ্য’ বিষয়ক চ্যাপ্টারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি জানায় , এটা এখন বোঝা যাচ্ছে হিজড়া “আসলেই কোন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক না”। 

আইসিডি-১১ নামে পরিচিত সবশেষ ম্যানুয়াল গ্রন্থটিতে লিঙ্গের অসামঞ্জস্যতাকে কোন ব্যক্তির লৈঙ্গিক অভিজ্ঞতা এবং লৈঙ্গিক পরিচয়ের অসামঞ্জস্যতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যদিও আগের ভার্সন আইসিডি-১০ এ মানসিক এবং আচরণগত ব্যাধি নামক চ্যাপ্টারে ট্রান্সজেন্ডারকে লিঙ্গ নির্ধারণ ব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। জাতিসংঘের ফ্রি অ্যান্ড ইক্যুয়ালের মতে পৃথিবীতে প্রায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ আন্তঃলিঙ্গ শিশু জন্মগ্রহণ করে। অর্থাৎ হাজারে ১ দশমিক ৭ জন। 

ভাতার অর্থ কি পৌঁছায় তাদের কাছে?

সরাকারিভাতা পেলেও কিছু অভিযোগও আছে,  ছেলে হিজড়া বিষয়টি তিনি গোপন করেননি বগুড়ার জামান আলি। তৃতীয় শ্রেণি থেকে ছেলে হিজড়া শিক্ষা উপবৃত্তির তালিকায় আছে। তবে এ পর্যন্ত কয়েকবার শুধু টাকা পেয়েছেন। 

বগুড়ার আরেক হিজড়া শিউলি (ছদ্মনাম) জানান, তাঁর গুরু মা তাঁকে সরকারের ভাতার কথা উল্লেখ করে চার-পাঁচ মাস পর পর এক-দেড় হাজার টাকা দেন। তবে এ টাকা কিসের জন্য দেওয়া হচ্ছে তা তিনি জানেন না। ‘ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক হিজড়া শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, যেহেতু অনেক শিক্ষার্থী কিছুটা গোপনেই এই গোষ্ঠীতে যুক্ত হন। যা করার গুরুমারা করে থাকেন। ভাতার জন্য গুরু মায়ের কাছে সরকারি কর্মকর্তারা তালিকা চান। ফলে ভাতার তালিকায় নাম উঠলে এই গুরু মায়েরা ভাতার বড় একটি অংশ নিজে নিয়ে নেন। 

সচেতন মহল কি ভাবছে? 

প্রকৃতির নিজস্বতায় আপনার মায়ের মতোই কোন মায়ের গর্ভে, আপনার পিতার মতোই কোন পিতার ঔরসে, আপনার ভাই-বোনদের মতোই কারো সহোদর হয়ে কিন্তু শারীরিক ভিন্নতা নিয়ে জন্ম নেন কিছু হতভাগা মানুষ। যাদেরকে কোন একটা পর্যায়ে স্নেহময়ী মা, দায়িত্ববান পিতা, আদরের ভাই-বোনেরা অস্বীকার করে বসেন। বলেন হিজড়া কমিউনিটি নিয়ে কাজ করা বগুড়ার কামারগাড়ির সুমি হিজড়া। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা এই হিজড়া ১৩ বছর ধরে কাজ করছেন এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে। 

তিনি আরো বলেন, ‘রাস্তাঘাটে কটুক্তি আর উপহাস তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী। স্বস্তিতে কোথায়ও বসবাস করবেন এ উপায়ও নেই। স্বাভাবিক পরিবেশ বলতে যা বোঝায় সেখানে কেউ আমাদের থাকতে দিতে চায় না। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ হিজড়াই বস্তিতে বসবাস করেন। যেখানে হিজড়া সন্তান এসে কোন পথে যাবে আপনিই বলেন! ‘ 

তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানরা নানা গুজব আর কু’তথ্যে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন শিশু-কিশোর বয়সেই। যা ভুল পথে নিতে বাধ্য করে। সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে কারিকুলামে এই সংক্রান্ত সঠিক তথ্য আনার দাবি জানান বগুড়ার হিজড়া অধিকার কর্মী শোভন সরকার।

ঘোর আপত্তি জানান বগুড়া সরকারি কলেজের মনোবিজ্ঞানীনের প্রভাষক মো. রাকিব হাসান।তিনি বলেন, ‘ আমাদের মিডিয়া, নাটকে সিনেমাতে একজন হিজড়াকে এত হেয় ভাবে উপস্থাপন করি যেন, আমার বাচ্চাও শিখে যে একে হেয় করতে হবে, এ একটা হাসির বস্তু। একে একটু চিমটি কাটা যাবে, ওকে একটু বিরক্ত করা যাবে। এর ফলে তাদের সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণাগুলো আরো পোক্ত হয়। অথচ মিডিয়ার দায়িত্ব হচ্ছে তাদের প্রতি যে সামাজিক অনাচার সংঘটিত হচ্ছে, রাষ্ট্র যে তাদের প্রতি অবহেলা করছে তা জনসমক্ষে তুলে ধরা।  আমরা কখনই ভাবি না এরা আমাদের ঘরেই জন্ম নেয়। এদের পিতা মাতা আমি বা আপনি ও হতে পারি।’

দায়িত্বশীলদের বক্তব্য কি –

বগুড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান মুঠোফোনে জানান, ‘একটি অভূতপূর্ব প্রযুক্তি বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েও মানুষের কাছে আজও তাঁর নিজ প্রজাতির লিঙ্গপরিচয় অস্পষ্ট। বিচিত্র লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের চিহ্নিত করতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কিছু আমব্রেলা টার্ম বা ‘ছাতা শব্দ’ ব্যবহৃত হয়।’

তিনি আরো বলেন,‘ তবে সরকার আন্তরিক। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি যেকোন সমস্যা সমাধানের জন্য। আমরা তাদের জীবন মান উন্নয়নে বদ্ধপরিকর।’ 

অবহেলিত জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা শিক্ষাবিদ নওশাদ-উর রহমান জানান, ‘সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়। তারা ২০১৯ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র তৃতীয় লিঙ্গে পরিচয় দিতে পারেন, একই সঙ্গে ভোট দেয়ার অধিকার পান।এখন নতুন এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথমবারের মত তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করতে পারবে তারা। যদিও মাঠ পর্যায়ে কতটুকু সুযোগ পাবে তা দেখার বিষয়। কারন মূলধারার শিক্ষাতেই অনেক গলদ আছে; যেখানে বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে লেখা গ্রন্থ ‘লিঙ্গ বৈচিত্র্যের বয়ান’র লেখক ড. জোবাইদা নাসরীনকে ই-মেইলে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে লিখেন, ‘সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের সবক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছে। তবে এখনও সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তৃতীয় লিঙ্গের কেউ কেউ চাকরি পেলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। এটার মূল কারণ আমাদের ধারণাগত সমস্যা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি হিজড়ারা জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী! তবে, আমরা কি এই সমাজে নিশ্চিত করতে পেরেছি হিজড়াদের সমানাধিকার? মুখে যতোই বলি সমতা! সমতা! বাস্তবতা তা বলে না। সমাজের মানুষ এখনও বিষফোঁড়া মনে করে তাদের। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবেই নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে প্রতিটি হিজড়া শিশু-কিশোর।’

হিজড়া পরিচয়ে কোনো শিশু কি আজো স্কুলে সংকোচ ছাড়া যেতে পারবে? কোনো পরিবার কি আজো তার সন্তানকে অকপটে হিজড়া হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে? উত্তর -না। পারবে না। দেবে না! দেয় না। এই যে লোকলজ্জার সংস্কৃতি এটি নিয়ে ভাবতে হবে। 

হিজড়াদের নিয়ে নিন্দা আর লজ্জা জারি রাখার সমাজ না পাল্টালে একটি হিজড়া কিশোর ভয়-লজ্জা-আড়ষ্টতা ও হীনমন্যতা নিয়ে বড় হবে। নিজেকে ছেলে বা মেয়ে বলে সমাজে একটা ছদ্ম পরিচয় দিয়ে সে যখন বেড়ে উঠবে তখন তার মনের মধ্যে জমা হবে ক্লেদ, দুঃখ ও বঞ্চনা। মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তবেই দূর হবে বৈষম্যের বাতাস।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2024 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS