দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ ও ‘যুগপৎ আন্দোলন’র রূপরেখা ঠিক করতে কাজ করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে দলটি। গত সপ্তাহ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে এ বৈঠক।
বৈঠকে সরকারবিরোধী ৩০টি দল ও সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এরই মধ্যে চারটি দলের সঙ্গে বৈঠকও করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের ইসলামীর সঙ্গেও বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে দিনক্ষণ এখনো জানায়নি দলটি।
স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াতের বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে কারো কারো আপত্তি এর আগে শোনা গেলেও এবার কারো বিরূপ প্রতিক্রিয় এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। এমনটি ২০ দলীয় জোটের বাইরে প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিতি সদস্য গঠিত ৭ দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকরাও সেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বৈঠককেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
বিএনপির মিত্র বা সরকারবিরোধী দলের নেতারা বলছেন, বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে একই মঞ্চে না উঠেও জামায়াত ইস্যু ঠিক রেখে আন্দোলন করলে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। দীর্ঘদিন রাজপথে থাকা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের সিদ্ধান্ত সঠিক বলেও মনে করছেন তারা।
জানা গেছে, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়ের পর পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, মহান মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করে আওয়ামী লীগ। ওই বিচারে ইতোমধ্যে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নেতার অনেকের রায় কার্যকর করা হয়েছে।
আবার কেউ কেউ মারা গেছেন বিচারাধীন থাকাবস্থায়। জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং দলটির ‘খাজাঞ্চি’ হিসেবে পরিচিত মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন নায়েবে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
কারাগারে সাজাভোগ অবস্থায় মারা গেছেন দলটির সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, নায়েবে আমির একেএম ইউসুফ আলী ও মাওলানা আবদুস সুবহান। এখনো জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলা আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
২০১৩ সালের আগস্টে দেশের সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে রায় প্রদান করেন। এ রায়ের পর থেকে জামায়াত তাদের নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে ভোট করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। সব মিলিয়ে জামায়াতের রাজনৈতিক ইমেজ বেশ ‘ক্রাইসিসে’।
আগামী নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠ এখন সরগরম হতে শুরু করেছে। তাই ইমেজ সংকটে পড়া ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতের বিষয়ে কৌশলী বিএনপি এখন ‘বৃহৎ ঐক্য’ গড়তে তৎপর। দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ের পর বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
জানা গেছে, বিএনপি দীর্ঘদিন থেকে বর্তমান সরকারবিরোধী দলগুলোকে এক কাতারে আনার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। জাতীয় এক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল ও বাম দলগুলোকে কাজে লাগাতে চাইছে বিএনপি।
ইতোমধ্যে সরকারবিরোধী ‘বৃহত্তর প্ল্যাটফরম’ গড়ে তুলে ‘যুগপৎ’ আন্দোলনের রূপরেখাও চূড়ান্ত করতে কাজ করছে বিএনপি। বছরের শুরু থেকে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আছেÑ এমন দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছে। তবে গত নির্বাচনের পর থেকে জামায়াতের বিষয়ে বেশ কৌশলী বিএনপি।
সম্প্রতি বিএনপির কর্মসূচিতে জামায়াত নেতাদের উপস্থিতি নেই বললেও চলে। ২০ দলীয় জোট থেকে বাদ দেওয়া হয়নি জামায়াতকে। আবার তাদের সঙ্গে সরাসরি পথও চলছে না দলটি। জামায়াতকে সরাসরি সঙ্গে না রেখে ভিন্ন কৌশলে কাজে লাগাতে চাইছে বিএনপি। নতুন কোনো জোট গঠন না করে অভিন্ন দাবিতে ভিন্ন প্ল্যাটফরম থেকে জামায়াতকে যুগপৎ আন্দোলনে কাজে লাগাবে বিএনপি।
এবার গত ২৪ মে থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করেছে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। ওইদিন মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিএনপির সংলাপ।
বিকেলে ওই সংলাপ শুরুর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, এবার বিএনপি জামায়াতের সঙ্গেও সংলাপ করবে। এরপর বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানা আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে কতিপয় বুদ্ধিজীবী বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে নেতিবাচক হিসেবে নিয়ে বিএনপিকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করতে তৎপরতা চালোনো হয় টাকশো, সভা-সেমিনার বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তবে বিষয়টিকে ২০ দলীয় জোট বা বিএনপির মিত্ররা কীভাবে দেখছেন, তা জানতে কথা হয় বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে। জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল বাংলাদেশের কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম বীরপ্রতীক ভোরের আকাশকে বলেন, যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতকে নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে, ঠিক আছে। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলমান অবস্থার অবসান ঘটাতে গণআন্দোলনের চেষ্টা করছে বিএনপি।
তাই বিএনপির আগামীর আন্দোলন নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ করতে চেয়ে কোনো ভুল বা অন্যায় করেছে, তা আমি মনে করি না। তাছাড়া জামায়াত একদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক; অন্যদিকে দীর্ঘদিন থেকে এ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে রয়েছে সেটিও মাথায় নেওয়া উচিত।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ প্রসঙ্গে ৭ দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক নাগরিক ঐক্যর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ভোরের আকাশকে বলেন, জামায়াত নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে নানা কারণে। তবে বিএনপি সরকারবিরোধী যে আন্দোলন করতে চাইছে, সেখানে ডান-বাম সবাইকে নিয়ে ঐক্যের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তাই জামায়াতের সঙ্গে বসতে সমস্যা কোথায়। অনেকেই বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে চললে দোষের না হলে বিএনপি বসলে সমস্যা কেন হবে।
এ বিষয়ে এলডিপির একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, একটা দল দীর্ঘদিন সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার। তাছাড়া তারা বিএনপির সঙ্গেই ছিল এতদিন। জাতীয় ঐক্য করতে হলে সবাইকে দরকার। দেশে এখন গণতন্ত্রহীনতা চলছে।
গণতন্ত্রহীনতার সমস্যা থেকে জামায়াত সমস্যা বড় নয় বলে মনে করছেন রাজপথে আন্দোলনকারীরা। তাই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সংলাপকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। জামায়াতকে আমরা ভয়ের কোনো কারণ হিসেবে দেখি না।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা ২০ দলীয় জোটের শরিক। বিএনপি আমাদের সঙ্গে সংলাপ করতেই পারে।
বিষয়টিকে কে কোনভাবে নিয়েছে, সেটি নিয়ে আমরা ভাবছি না। কবে কোথায় সংলাপ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পত্রিকায় দেখেছি বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ করতে চায়। এর বাইরে আমি এখনো কিছু জানি না।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply