স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে বিক্ষোভরত গণঅভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালে ফিরে গেছেন।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) দিবাগত গভীর রাতে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান পঙ্গু হাসপাতালের সামনে আসেন। তাদের দাবি পূরণের আশ্বাসে সড়ক থেকে হাসপাতালে ফিরতে রাজি হয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
এ সময় উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় সচিবালয়ে আহতদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বৈঠক হবে। কীভাবে তাদের পাশে সরকার থাকতে পারে, সে বিষয়ে সেখানে আলোচনা করা হবে।
বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের ব্যর্থতা আছে, ভুল আছে। আপনাদের প্রতি আমাদের অনেক অনেক অনেক বেশি দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি। চেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু আমরা করতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রধান উপদেষ্টার কাছে গিয়েছি। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে বলেছিলেন যে সবার চিকিৎসাসহ যা কিছু দরকার, তা উনি করবেন। আমাদের অবশ্যই ঘাটতি ছিল। আপনাদের এভাবে বসে থাকা আমাদের ভালো লাগছে না। এটি আমাদের জন্যও হৃদয়বিদারক ঘটনা।
এর আগে বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার পর অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ আহতরা বিছানাপত্র নিয়ে এসে পঙ্গু হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান করার ঘোষণা দেন।
আহতদের দাবি, চিকিৎসায় নানা দিক থেকে অবহেলার শিকার হচ্ছেন তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের চারজন উপদেষ্টা এসে তাদের সঙ্গে কথা বলে সুচিকিৎসার আশ্বাস না দেওয়া পর্যন্ত তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। এ সময় দাবি আদায় না হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও দেন তারা।
এদিন রাত ১২টার দিকে দ্বিতীয় দফায় সেখানে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, আন্দোলনকারীরা যে চারজন উপদেষ্টাকে এখানে আসার দাবি জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে দুজন ঢাকার বাইরে, একজন বিদেশে ও আরেকজন ক্যানসারের রোগী। তারা চাইলে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এখানে আসতে পারেন। আর তা না হলে বৃহস্পতিবার বেলা ২টা পর্যন্ত সময় দেওয়া যায়, তখন উপদেষ্টাদের সঙ্গে বসা যাবে। উপদেষ্টাদের কাছ থেকে আহত ব্যক্তিদের দাবির বিষয়ে লিখিত নেওয়ার কথা বলেন তিনি।
এ সময় আহত আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে একজন বলেন, ‘আমরা হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে একমত। কালকে চার উপদেষ্টা আসা পর্যন্ত আমরা এখানে অবস্থান করব।’ হাসপাতাল থেকে বিছানাপত্র নিয়ে এসে সবাই সড়কে অবস্থান করবেন বলে ঘোষণা দেন তিনি। এরপর থেকে ক্ষুব্ধ আহতরা বিছানাপত্র নিয়ে এসে পঙ্গু হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান নেন।
ঘটনার শুরু বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুককে সঙ্গে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে যাওয়ার পর। তারা চতুর্থ তলার পুরুষ ওয়ার্ড প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ঘুরে দেখেন এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। এক পর্যায়ে তারা চলে যেতে চাইলে তিন তলার ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীনদের দেখতে না যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন গণআন্দোলনে আহতরা। পরে নিচে এসে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন কয়েকজন।
হাত, পা, চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা এই রোগীরা হুইলচেয়ারে করে হাসপাতালের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। তারা বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সবার সঙ্গে দেখা না করা পর্যন্ত রাস্তা ছাড়বেন না। এ ছাড়া ঘোষণার পর এখনও আহত ব্যক্তিদের ১ লাখ করে টাকা না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। এর পর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার অন্য গাড়িতে করে স্থান ত্যাগ করেন।
জানা যায়, ঘটনাটি পঙ্গু হাসপাতালের সামনে হলেও অধিকাংশ বিক্ষোভকারী ছিলেন চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসাধীন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, আহতদের প্রত্যাশা ছিল স্বাস্থ্য উপদেষ্টা যেন সবার খোঁজখবর নেন। সমস্যা শুনে সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেন। কিন্তু মনের কথাগুলো শোনাতে না পেরে আহতরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ সময় কেউ কেউ চিকিৎসার মান নিয়েও অভিযোগ করেছেন। জানা যায়, আহতরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নির্ধারিত প্রেস ব্রিফিং না করেই চলে যান।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আল মিরাজ বিক্ষোভে অংশ নিয়ে বলেন, দেশে তার চিকিৎসা নেই। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া জরুরি। তবে এ বিষয়ে অগ্রগতি নেই। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পঙ্গু হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের খোঁজ নিতে এলেও তিনি আজ চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন চোখে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের খোঁজ নিতে যাননি।
ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জিয়াউল হক বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নিরাপদে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন। তার গাড়িটি অক্ষত আছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পরিচালক ডা. কাজী শামীম উজজামান জানান, যুক্তরাজ্য থেকে আসা দু’জনের চিকিৎসক দল হাসপাতালে আহত ৮৫ রোগীকে দেখেছেন। তারা ১৬ জনের সার্জারি করেছেন এবং বৃহস্পতিবার আরও দু’জনের সার্জারি করবেন।
এদিকে বিকেলে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সম্পাদক মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলতে যান। তিনি আহতদের সুচিকিৎসা ও প্রয়োজনে বিদেশে নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে বিক্ষোভকারীদের হইচইয়ের মুখে স্নিগ্ধ কথা শেষ করতে পারেননি।
আর রাত ৯টার দিকে প্রথম দফায় আহতদের সঙ্গে কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। সমস্যা সমাধানে উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, তিন মাস পর আমার ভাইয়েরা এখনও রাস্তায় আছে, এটাই সবচেয়ে লজ্জার। এর সমাধান কীভাবে করা যায়, সেজন্য আমাকে একটু সময় দেন। যে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন এত দিনে আহতদের চিকিৎসায় টাকা দিতে পারে না, সেই ফাউন্ডেশন রাখার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply