বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৭ পূর্বাহ্ন

চবি নাট্যকলা বিভাগ: নাটক নিয়ে স্বপ্ন দেখেন যারা

তানজিম হাসান পাটোয়ারী
  • আপডেট : মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সংস্কৃতির একটি প্রাচীন শাখা হিসেবে যে মাধ্যমটি মানুষের কাছে বেশ সমাদৃত সেটি হলো নাটক। শুধু বিনোদনের খোরাকই নয়, বরং কখনো কখনো মানুষের আবেগ ও অনুভূতির সাথে মিশে এটি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে। কালের বিবর্তনে নাটক নির্মাণ ও এর কাহিনী পরিক্রমায় ভিন্নতা আসলেও সংস্কৃতি চর্চা কিংবা আত্নিক বিকাশের ক্ষেত্রে এখনো তার নিজ আসন সমুন্নত করে রেখেছে প্রাচীন এ শিল্পটি।

বর্তমানে নাটক নির্মাণশৈলীকে আরো এগিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চালু হয়েছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। নাট্যকলার উপর উচ্চশিক্ষা নিয়ে একজন শিক্ষার্থী পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারেন এ ক্ষেত্রটিকে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগও এগিয়ে চলেছে দুর্দান্ত গতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের নাটকের জগতে অবাধ বিচরণ সে দিকটিকেই নির্দেশ করে।

এসব বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের একঝাঁক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা তুলে ধরেন নাটক নিয়ে তাদের ভাবনা এবং প্রত্যাশার কথা। প্রথমেই কথা হয় মনোহিত নৃর সঙ্গে। তিনি বলেন, “নাটকের পরিধি এত বিস্তৃত যে এটিকে অল্প কথায় তুলে ধরা কঠিন। আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে নাটক নিয়ে কাজ করেন। কেউ অভিনয় করেন, আবার কেউ নাটক নির্মাণের দায়িত্ব পালন করেন। আর বর্তমান যুগ যেহেতু তথ্য প্রযুক্তির যুগ তাই এখন প্রযুক্তির সুবাদে ইউটিউব, চরকির মতো বেশ কিছু অনলাইন বিনোদন মাধ্যম তৈরি হয়েছে যেখানে একজন দর্শক সহজে তার পছন্দের নাটকটি উপভোগ করতে পারেন। এতে একদিকে যেমন আমাদের কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক তেমনি এটি আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়াতেও সাহায্য করে।”

এ বিষয়ে আরো কথা বলেন নাট্যকলা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী শামীম রানা শামু যিনি নাটকে অভিনয় করার পাশাপাশি কাজ করছেন নাটক নির্মাণেও। তিনি বলেন, “আমরা নাটক নির্মাণ করি মানুষকে উজ্জীবিত রাখতে এবং দর্শকদের কাছে নতুন কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে যেটি সমাজ ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক। নাটক নির্মাণের সাথে জড়িত থাকার সুবাদে আমি মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করি যেখানে দর্শকদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাই। এতে একদিকে যেমন দর্শকদের কাছে আমাদের চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরার সুযোগ হয়, ঠিক তেমনি আমাদের মনোবলও বেশ উৎফুল্ল থাকে। আমি মনে করি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে নাটককে অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।”

মনোহিত এবং শামীমের মুখে নাটক নিয়ে তাদের ভাবনার কথা সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের মাঝে নব আশার সঞ্চার করে। বর্তমানে টেলিভিশন কিংবা অনলাইন মাধ্যমগুলোতে নাটকের দর্শকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ভালো গল্প এবং দক্ষ শিল্পীদের এ পেশায় নিয়ে আসা গেলে আগামীতে এ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে করছেন এ শিল্পের সাথে জড়িত বিশিষ্টজনরা।

বর্তমানে নাটকে নিয়মিত কাজ করছেন পলি চৌধুরী। তিনিও অধ্যয়ন করছেন নাট্যকলা বিভাগে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নাটকের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে। তিনি বলেন, “বর্তমানে নাট্যশিল্পে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যেমন আগে যেখানে অভিনয়ের ক্ষেত্রে একজন ছেলে কিংবা মেয়ের বাহ্যিক সৌন্দর্যের দিকটি সবচেয়ে বেশি প্রধান্য দেওয়া হতো এখন সেখানে প্রাধান্য দেওয়া হয় একজন শিল্পী অভিনয়ের ক্ষেত্রে কতটা দক্ষ সেটির উপর। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। কারণ এতে করে সত্যিকার অর্থে যারা অভিনয়কে নিজের মধ্যে ধারণ করেন তারা কাজ করার সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি এ শিল্পে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার জন্য যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি একজন ব্যক্তিকে শিল্পী সমাজে আরো বেশি পরিচিত হয়ে উঠতে সাহায্য করে।”

বর্তমানে নাট্যশিল্প বহুদূর এগিয়েছে এ কথা যেমন সত্য ঠিক তেমনি এখানে থাকা কিছু সমস্যার কথাও কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আর এসব সমস্যা চিহ্নিত করাটাও এ শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের একটি অন্যতম দায়িত্ব।

নাটকের জগতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেন নাট্যকলা বিভাগে অধ্যয়নরত রাচি চৌধুরী যিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই কাজ করছেন নাটকে। তিনি বলেন, “নাটকে কাজ করতে গিয়ে যে সমস্যাটির কথা সবার আগে আসে সেটি হলো মানুষের মাঝে সঠিক মূল্যায়নের অভাব। পারিবারিকভাবেও অনেক সময় এ পেশায় আসাকে নিরুৎসাহিত করা হয় যেহেতু এখানে একজন শিল্পীর পারিশ্রমিকের বিষয়টি অনেক সময় অবহেলিত থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের মিডিয়া সংস্থাগুলোর বেশিরভাগই ঢাকা কেন্দ্রীক হওয়ায় অন্য জেলা থেকে গিয়ে সেখানে কাজ করতে প্রায়ই সমস্যা পোহাতে হয়। পাশাপাশি অনেক নির্মাতারা তাদের নাটকে নবীনদের সুযোগ দিতে অনীহাবোধ করেন। এর ফলে অনেকেই এ শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।”

তবে সমস্যা যেমনই হোক না কেন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে যে কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব। তাহলে নাট্যশিল্পে যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলোর সমাধান কি হতে পারে সেসব বিষয়ে কথা বলেন নাট্যকলা বিভাগের তিন শিক্ষার্থী নিশীথ শামীম, সনজিত কুমার দে এবং ইউনূস রানা।

এ বিষয়ে প্রথমেই কথা হয় নিশীথ শামীমের সঙ্গে। তিনি বলেন, “প্রত্যেক শিল্পীকেই নবীন অবস্থায় কাজ শুরু করতে হয়। প্রথমেই কেউ অভিজ্ঞ হয়ে এ শিল্পে আসে না। তাই নাটক নির্মাতাদের অবশ্যই নবীনদেরকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। কারণ নবীনদেরকে কাজ করার ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রাধান্য দিলে আগামীতে আমরা অনেক দক্ষ নাট্যশিল্পী পাব যা এ শিল্পকে আরো এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এছাড়া ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য জেলাগুলোতে নাট্যচর্চার সুযোগ আরো বাড়ানো উচিত যাতে করে একজন দক্ষ নাট্যকর্মী যেখানেই অবস্থান করুক না কেন সেখান থেকেই নাট্যচর্চার সুযোগ সুযোগ পেতে পারেন।”

অন্যদিকে সনজিত কুমার দে তুলে ধরেন শিল্পীদের সঠিক মূল্যায়নের বিষয়টি। তিনি বলেন, “নাটককে আগামীতে সবার কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করতে হলে এখানকার শিল্পীদের সম্মানের সাথে মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে একজন শিল্পীর উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিষয়টিও। কারণ কাজ শেষে উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পেলে অনেকেই কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।”

বর্তমানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে সব ক্ষেত্রে। এর থেকে বাদ যায় নি নাট্যশিল্পও। বর্তমানে এ শিল্পে চালু হয়েছে অনলাইন ভিত্তিক কিছু মাধ্যম। ইউনূস রানার কথায় উঠে আসে অনলাইন ভিত্তিক মাধ্যমগুলোর প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, “তথ্য-প্রযুক্তির সুবাদে বর্তমানে দর্শকরা কিছু অনলাইন মাধ্যমের সাহায্যে তাদের পছন্দের নাটক উপভোগ করতে পারেন। অথচ অনেকগুলো অনলাইন মাধ্যম এখনো মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিতি পায় নি। তাই এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি।”

বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে নাটক সবসময় একটি অনবদ্য নাম। বিনোদন কিংবা শিক্ষামূলক অভিব্যক্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামেও নাট্যজনরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই আগামীতে সকল বাধা দূর করে এ শিল্প আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে এমনটিই এখন সকলের প্রত্যাশা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS