বগুড়া প্রতিনিধি: দেশে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ উপলক্ষ্যে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা নিজেদের মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে নানা প্রকল্প উপস্থাপন করে আসছে।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি নিয়ে জানা ও গবেষণায় পিছিয়ে নেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের এই শিক্ষার্থীরাও। দেশের নান সমস্যা ও সংকট সমাধানের উপায় বিভিন্ন উদ্ভাবনের মাধ্যমে তুলে ধরছেন শিক্ষার্থীরা। ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে তাদের প্রকল্প তুলে ধরার জন্য।
বিভিন্ন মেলায় দেশের স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক প্রকল্প সামনে এনেছে। এরমধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ইকো ফ্রেন্ডলি শহরের মডেল, স্বল্প খরচে জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা।
এছাড়া কেউ পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিদ্যুৎ ও পানির অপচয় রোধ ও বনায়ন, কেউ সামুদ্রিক পানির ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃত্রিম রোবট তৈরি, পেট্রোল আর পানি থেকে গ্যাস তৈরি, বিদ্যুৎ অপচয় রোধে করণীয়, পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার কৌশল নিয়ে ডেমো তৈরি, কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প পদ্ধতি, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট প্রকল্প নিয়ে হাজির হচ্ছে এসব আয়োজনে।
কেউ ডেমো দেখাচ্ছে দেশীয় অর্থনীতিতে স্বল্প খরচে প্রযুক্তি ও পরিবেশ বান্ধব স্বপ্নের শহর নির্মাণের কৌশল, বর্জ্য রিসাইক্লিন পদ্ধতি, বায়ু দূষণে করণীয় বিষয়ে। আবার কেউ দেখাচ্ছে কী করে কাদা থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করতে হয়।
হাইড্রোলিক লিফট, মিরর পাওয়ার প্লান্ট, অটো ক্লিনার্স, হাইড্রোবোট এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে টোল আদায়ের উপায় নিয়েও কাজ করছে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা।
এমন সব অভিনব প্রকল্প নিয়ে অনেক আশাবাদী হয়ে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা হাজির হয় বিজ্ঞান ও শিল্পপ্রযুক্তি মেলায়। কিন্তু তাদের এই উপস্থাপনা মেলাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। মেলার সমাপনী দিনে পুরস্কার বিতরণীর আয়োজনেই সমাপ্ত হয় বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। আলোর মুখ দেখে না ভবিষ্যতে। পরে আর কাজে লাগানো হয় না। অন্যদিকে প্রণোদনার বিষয়ও চোখে পড়ে না।
মেলায় অংশ নেওয়া বগুড়ায় বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিউল বারি নাবিল বলেন, ‘ বিজ্ঞান তো মজার বিষয়! ভালো তো লাগে কিন্তু আমরা এত সুন্দর আবিষ্কার করছি তা তো ভবিষ্যতে কিছু করার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ। বিজ্ঞানী হবো কিনা জানি না তবে এখনই তো আবিষ্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাহলে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কি! ’
ইকো ফ্রেন্ডলি শহরের মডেল নিয়ে নুজহাত বিনতে স্পর্শ ও তার দলের উপস্থাপন। স্পর্শ জানান,‘ আগ্রহ নিয়েই মেলায় অংশ নিই প্রতিবার কিন্তু সত্যি বলতে মেলার ঠিক আগে আগে আমরা একটা মডেল তৈরি করি আর সারাবছর কোন কিছু করি না। কারন, আমাদের আবিষ্কার তো কিছুই করা হয় না। প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার মধ্যেই শেষ। সেজন্য আগ্রহও কম। যদি কাজে লাগানো যেতো…. তাহলে আগ্রহ নিয়ে আরো কাজ করতাম। ’
দেশের সম্ভাবনাময় ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের মেধা-মননের বিকাশের পাশাপাশি আবিষ্কারগুলো যাতে কালের আবর্তে হারিয়ে না যায়, এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে দাবি করেন মেলায় প্রকল্প দেখতে আসা খন্দকার যুন-নূরাইন নামের এক অভিভাবক।
আমাদের দেশীয় বিজ্ঞান-চর্চার যে একটা ধারা আছে, তা আমরা ভুলতে বসেছি। জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-সাধনা থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা এবং কাজী মোতাহার হোসেনের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
মুহম্মদ নওশদ-উর রহমান নামের এক বেসরকারি কলেজের শিক্ষক জানান, ‘দেশের সম্ভাবনাময় ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে হবে। সেজন্য দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও প্রণোদনা। তাদের এ আবিষ্কার মেলার আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। পরে তা আর কোনো কাজে লাগানো হয় না। এটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। মেধাকে মূল্যায়ন না করে শুধুমাত্র প্রদর্শনীতেই থেকে যাচ্ছে। ’
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে শিশুর মতামত প্রদানের অধিকার, বৈষম্যহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার এবং শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ দেখার কথা বলা আছে।
অনুচ্ছেদ ১২-এ বলা হয়েছে, ‘যে সমস্ত বিষয় শিশুর জীবনকে প্রভাবিত করে সে সকল বিষয়ে নিজস্ব মতামত গঠনে সক্ষম একটি শিশুর স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করবে। শিশুর বয়স এবং চিন্তাশক্তির পরিপক্বতা বিবেচনা করে তার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।’
এসব আবিষ্কার আলোর মুখ না দেখা কি বৈষম্য না? সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এসব প্রক্ল্প বা আবিষ্কার কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিশুদের সৃজনশীল কাজে প্রণোদনা দিতে হবে। না হলে শিশুর আগ্রহ কমতে থাকবে। যেহেতু মেলা শেষেই আর কোন কাজে আসবে না এসব প্রকল্প। শিশুদের আবিষ্কার গুরুত্ব না দেওয়াও সর্বোত্তম স্বার্থ অবহেলার শামিল!
মেলা সংশ্লিষ্ট আয়োজন কমিটির সূত্র বলছে, এসব প্রকল্পের কিছু প্রকল্প বা আবিষ্কার কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে তা খুব শীঘ্রই আলোর মুখ দেখবে কি না তা নিশ্চিত নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা সরকারি নীতিমালা ও আইনের আওতার কথা উল্লেখ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন বক্তব্য। জানান নির্দেশনা আসলে অবশ্যই এই আবিষ্কার কাজে লাগানো হবে।
বলা হয় আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। আগামীতে নেতৃত্ব দেবে দেশ ও জাতিকে, আচার-আচরণ, ব্যক্তিত্বই পরিলক্ষিত হবে দেশ ও জাতির ওপরে। কাজেই শিশুর আবিষ্কারকে গুরুত্ব দিয়ে তা বড়সড় বাণিজ্যিকরণের উদ্যোগ নিলে শিশুদের আরো মেধা বিকশিত হবে ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহী হবে।
ছবি: সংগৃহীত
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply