শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪০ অপরাহ্ন

ব্যবসায়ীদের যে ৮ কাজ করতে নিষেধ করেছেন নবীজি

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : শনিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৩
  • ২৪৭ Time View

আল্লাহ রব্বুল আলামিন ব্যবসা হালাল করেছেন। নবীজি ব্যবসা করেছেন। তিনি ভালো ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত মানব ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। মানব অস্তিত্বের প্রথম দিন থেকে এ প্রথা চালু হয়েছে, মানব অস্তিত্বের শেষ দিন পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত থাকবে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে। নবী কারিম সা. বলেন, ‘সৎ আমানতদার ব্যবসায়ী নবীগণের সঙ্গে হাশর করবে।’ (তিরমিজি ১২০৯) একজন সৎ ব্যবসায়ীর নৈতিক দায়িত্ব কী হবে, রসুল সা. বলে দিয়েছেন। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তিনিও এসব বিষয় থেকে সবসময় দূরে ছিলেন, সাহাবায়ে কেরামকেও দূরে থাকতে বলেছেন।

মিথ্যা কথা থেকে বিরত থাকা

মিথ্যা কথা বলা ব্যবসায়ীদের একটি চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা শপথ করতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করে না। কোরআনে কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেও না। তবে পরস্পর সম্মতিক্রমে বেচাকেনার মাধ্যমে’। (সুরা: নিসা ২৯) রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে মিথ্যার কলুষতা থেকে মুক্ত রাখার নির্দেশ দেন। 

রসুল সা. বলেন, ‘বেচাকেনার সময় পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত লেনদেন গ্রহণ ও বর্জন করার অধিকার ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে সংরক্ষণ করে। তারা যদি পণ্য ও বিনিময় দ্রব্যের গুণাগুণ যথাযথ বর্ণনা করেন, সত্য কথা বলেন, তবে তাদের বেচাকেনার মধ্যে বরকত দেয়া হয়। আর যদি মিথ্যা বলেন কিংবা গুণাগুণ গোপন করেন, তবে বেচাকেনার বরকত নষ্ট করে দেয়া হয়’। অন্য হাদিসে রসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্যের দোষ-ত্রুটি ক্রেতার নিকট প্রকাশ করে না, সে সর্বদা আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত থাকে।’

ব্যবসায় প্রতারণার আশ্রয় নেয়া

ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হারাম। ক্রেতাকে ঠকানোর জন্য পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করা জায়েজ নয়। হযরত ইবনে উমর রা. বলেন, নবী করিম সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’। অন্য হাদিসে আছে, ‘রসুলুল্লাহ সা. প্রতারণামূলক বেচাকেনাকে নিষিদ্ধ করেছেন’। (মুসনাদে ইমাম আবু হানিফা)। 

এ বিষয়ে তিরমিজিতে একটি হাদিসে আছে, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার খাদ্যপণের একটি স্তূপের মধ্যে হাত প্রবেশ করালে কিছুটা আদ্রতা অনুভব করেন, তিনি খাদ্যশস্যের মালিককে বলেন, কী ব্যাপার এ খাদ্যশস্য ভিজা কেন? তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল! এ খাদ্যশস্যের ওপর বৃষ্টির পানি পড়েছিল। রসুল সা. বলেন, তবে ভিজে যাওয়া পণ্য ওপরে রাখলেনা কেন? যাতে মানুষ তা দেখতে পেত। এরপর তিনি বলেন, শোন, ‘যে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়’। (মুসলিম শরিফ ২৪৮)। 

আরবের লোকেরা দুধের পশু বিক্রি করার সময় প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করত। তারা কয়েক দিন পর্যন্ত পশুটির দুধ দোহন না করে রেখে দিত, এতে স্তনে দুধ জমা হয়ে স্তন ফুলে যেত আর গ্রাহক দেখে মনে করত পশুটি প্রচুর দুধ দেয়, এই ভেবে তারা চড়া মূল্যে তা ক্রয় করে প্রতারিত হত। রসুলুল্লাহ সা. এভাকে পশু বিক্রি করতে নিষেধ করেন। (বুখারি ও মুসলিম)

পণ্য মজুদদারী

অধিক মুনাফা লাভের আশায় আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ পণ্য মজুদ বা ষ্টক করে রাখে। তারা এভাবে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। রসুল সা. তাদের পাপাচারী বলেছন। এতে মানুষ খুব কষ্ট পায়। ইসলাম এ কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করাকে কোনোভাবেই মেনে নেয় না। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি মজুদদারী করে সে পাপাচারী’। (শুয়াবুল ঈমান) 

তবে মনে রাখতে হবে, মজুদদারী সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ নয়। যদি মজুদদরীর কারণে বাজারে পণ্য-সংকট সৃষ্টি না হয়, অথবা সে উদ্দেশ্যে মজুদদরী করা না হয় তবে তা জায়েজ। সুতরাং মৌসুমের বিপুল আমদানিকালে কম মূল্যে পণ্য খরিদ করে স্টক করে রেখে পরে তা অধিক মূল্যে বিক্রি করা বৈধ। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য বাজারে ছেড়ে দেয়া সর্বাবস্থায়ই উত্তম।

ওজনে কম দেয়া

মহান আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে তারা পুনরুত্থিত হবে কিয়ামতের দিবসে, যে দিন সব মানুষ দাঁড়াবে মহান প্রতিপালকের সামনে?। (সুরা মুতাফ্‌ফিফিন ১-৬)। 

ওজনে কম দেয়া ঘৃণিত কাজ। ইসলামি শরিয়ত কখনো তা সমর্থন করে না। যারা ওজনে কম দেয় তাদের এ ঘৃণ্য কাজের বর্ণনা দিয়ে কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা স্বতন্ত্র একটি সুরা অবতীর্ণ করেন। সুরা মুতাফফিফিন। এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে বুঝতে পারি, মাপে কম দেয়া হারাম ও নিষিদ্ধ। তবে মনে রাখতে হবে, ‘মুতাফ্‌ফিফিন‘ শব্দের অর্থ শুধু মাপে কম দেয়া না, বরং যে কোনো প্রাপককে যথাযথ প্রাপ্য না দেয়া। সেটা গণনার মাধ্যমে হতে পারে আথবা অন্য কোনো উপায়েও হতে পারে। প্রাপককে আপন হক থেকে বঞ্চিত করাই মূল উদ্দেশ্য।

মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়

মিথ্যা শপথ করা মারাত্মক গুণাহ। যাকে কবিরা গুনাহ বলে। যে গুনাহ জাহান্নামে পৌঁছে দেয়ার জন্য যতেষ্ট। কবিরা গুনাহ বা বড় গুনাহ যা দাওবা ছাড়া মাফ হয় না। তার ওপর ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর নিষেধাজ্ঞা আরো বেশি। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে অন্যের হক সংশ্লিষ্ট থাকে। অথচ আমাদের সমাজের ব্যবসায়ীদের প্রায়ই দেখা যায়, তারা পণ্যকে বেশি দামে বিক্রয় করার জন্য মিথ্যা শপথ করে।

যেমন একটি পণ্য বিক্রেতার ১০০ টাকা কেনা পড়েছে, সে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলে আল্লাহর কসম আমি এই পণ্যটি ১৫০ টাকায় কিনেছি। ক্রেতা তার কথার ওপর ভিত্তি করে চড়া মূল্যে তা খরিদ করে নিয়ে যায়, প্রতারণার শিকার হয়। 

মিথ্যা শপথের ব্যাপারে কোরআনে কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে কৃত অঙ্গিকার সামান্য মূল্যে বিক্রি করে তাদের আখেরাতে কোনো অংশ নেই। আর তাদের সাথে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না। তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি দিবেন না। তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। (আল ইমরান ৭৭)

এ আয়াত সম্পর্কে হযরত আবু যর রা. বলেন, রসুল সা. বলেন, তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। তাদেরকে মার্জনা করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আমি বললাম হে আল্লাহর রসুল তারা কারা? তারা তো বড় বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা হলো অনুগ্রহ করার পর তা প্রকাশকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী। রসুল সা. এই আয়াত পড়েন। (মুসলিম ২৪৩)।

রসুল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথার মাধ্যমে কারও হক নষ্ট করে সে নিজের জন্য জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত করে নেয়। তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়। বর্ণনাকারী বললেন, যদি বিষয়টি সামান্য পরিমাণে হয় তবুও? উত্তরে তিনি বলেন, তা গাছের একটি তাজা গাছের ডালই হোক না কেন।’

সত্য শপথ থেকেও বিরত থাকা

ব্যবসার ক্ষেত্রে সত্য শপথ থেকেও বিরত থাকা উচিত। কারণ একবার শপথ করার অভ্যাস হয়ে গেলে তা আর ফিরানো যায় না। তাছাড়া বেশি বেশি শপথ করা এটা ইসলামের দৃষ্টিতেও খারাপ কাজ। এ কারণেই ফকিহগণ সত্য শপথ করাকেও মাকরুহ বলেছেন। রসুল সা. বলেন, শপথ পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করে ঠিক, কিন্তু তা ব্যবসার বরকত নষ্ট করে দেয়। অপর বর্ণনায় আছে ‘তোমরা বেচাকেনার ক্ষেত্রে অধিক শপথ থেকে বিরত থাক, কেননা তা পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও বরকত নষ্ট করে দেয়।’ (মুসলিম)

অন্যের দরদামের ওপর দরদাম না করা

অনেক সময় দেখা যায় একজন একটা পণ্যের দরদাম করছে, পাশ থেকে আরেক জন এসে বেশি দামে বস্তুটা নিয়ে যায়। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। ক্রেতা বিক্রেতার চূর্ড়ান্ত কথাবার্তা শেষ হওয়ার আগে অপর কেউ তার ওপর দামাদমি করা ইসলামি শারিয়দে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ বিক্রেতা গ্রাহক সংখ্যা বেশি দেখে পণ্যের দাম ন্যায্য মূল্য থেকে বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে সাধারণ আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই রসুল সা. এ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন, এক জনের দরদামের ওপর দরদাম কর না। (তিরমিজি ২৪২)। তবে ক্রেতা বিক্রেতার কথা চুড়ান্তভাবে শেষ হয়ে গেলে তৃতীয় কোনো খরিদদার তা মূলাতে পারবে।

সংশয়পূর্ণ লেনদেন থেকে বিরত থাকা

ব্যবসা-বাণিজ্যে হিডেন বা গোপনীয় কোনো কিছুই শরিয়ত সম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে কিছু জিনিস স্পষ্ট হালাল। কিছু বিষয় স্পষ্ট হারাম। যা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। ব্যবসায় কিছু বিষয় আছে সংশয়পূর্ণ, সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে না। বিষয়টি কি হালাল না হারাম এ নিয়ে তাদের মাঝে সন্দেহ দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে সৎ ব্যবসায়ীর দয়িত্ব সংশয়পূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। ইসলামও সন্দেহ সংশয়পূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়। হিডেন কোনো কিছু না রেখে খোলাখুলি ক্রেতাকে সব বিষয়ে বলা। রসুল সা. ব্যবসা করেছেন। ব্যবসার নীতি-নৈতিকতা তার থেকেই আমরা শিখতে পারি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2024 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS