বরিশাল অফিস: চৈত্রের মাঝারী থেকে ভারি বর্ষণে এবারো কপাল পুড়ল দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক তরমুজ চাষির। প্রায় ৫ মাস পরে মার্চের মধ্যভাগে থেকে কয়েক দফা হালকা বৃষ্টিপাতের পরে মাসের শেষ ভাগে মাঝারী-ভারি বর্ষণের সাথে ফুসে ওঠা সাগরের জোয়ারের পানিতে ভোলা সদর, চরফ্যাশন, পটুয়াখালীর খেপুপাড়া, বরগুনার বামনা, পাথরঘাটা ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া সহ উপকূলীয় কয়েকটি এলাকার তরমুজ ক্ষেতে পানি জমে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন চাষীরা।
মার্চে আবহাওয়া বিভাগ থেকে বরিশালে ৫৩ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিলেও সারা মাসের শেষ ১০ দিনে বৃষ্টি হয়েছে ১০ মিলিরও কম। অথচ এর সাথে জোয়ারের পানিতে তরমুজ চাষিরা সর্বশান্ত হয়ে গেছেন। বৃষ্টি ও জোয়ারের প্লাবনে অনেক এলাকার চাষিরা মাঠ থেকে তরমুজ উত্তোলণ করতে পারেননি।
আবার কিছু এলাকা থেকে উত্তোলিত তরমুজ বরিশালের পোর্ট রোডের পাইকারি বাজারে এলেও তাতে পচন ধরায় সংলগ্ন জেলখালসহ কীর্তনখোলা নদীতে ফেলে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। চাষীদের অনেক কষ্টের তরমুজ ভোক্তার পরিবর্তে নদী ও খালে ভাসছে। ফলে আরো একবার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলো দক্ষিণাঞ্চলের তরমুজ চাষীদের।
গত বছর এপ্রিলের শুরু থেকে রোজা এবং মে মাসের শুরুতে ঈদের কারণে তরমুজের বাজার ছিল মন্দা। ফলে চাষিরা ঈদের পরে বাজার ধরার আশায় অপক্ষোয় ছিলেন। কিন্তু ঈদের পর পরই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্ন চাপ ‘অশনি’র প্রভাবে উপকূলয়ি এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাতে দক্ষিণাঞ্চলে অন্তত ১০ লাখ টন তরমুজ বিনষ্ট হয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েন লক্ষাধিক চাষি।
গত মৌসুমে রোজা শুরুর আগেই বাজারে তরমুজ আসতে শুরু করলেও পাইকারদের নানা অজুহাতে চাষিরা ভাল দাম পায়নি। তবে ভোক্তাদের বাজার থেকে অনেক বেশী দামেই তা কিনতে হয়েছে। উপরন্তু ঈদকে সামনে রেখে চাহিদা কমে যাওয়ায় চাষিরা দর পতনের আশংকায় রোজার শেষ দিকে মাঠ থেকে তরমুজ উত্তোলণ ও বিক্রি না করলেও অশনি তাদের সব কেড়ে নিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, এবারো দেশে আবাদ ও উৎপাদনের ৭০ ভাগেরও বেশি তরমুজের যোগান দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল। তবে মাঠ পর্যায়ে ভাল দাম না পেয়ে কৃষকদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন ঘটছে না । উপরন্ত চৈত্রের বর্ষণে কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বপ্নের তরমুজে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটছে।
গত বছর রবি মৌসুমে দেশে প্রায় ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে ২৭ লাখ টনের মত তরমুজ উৎপাদন হলেও দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলাই ৩৭ হাজার হেক্টরে উৎপাদন ছিল প্রায় ১৭ লাখ টনেরও বেশি। কিন্তু এবার পরিস্থিতির আশাতীত উন্নতি হয়েছে।
ডিএই’র মতে, এবার বরিশাল,পটুয়াখালী,ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠীর উঁচু ও উপকূলীয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপসহ নদী তীরবর্তি প্রায় ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। ডিএই দক্ষিণাঞ্চলে এবার হেক্টর প্রতি প্রায় ৪২ টন হিসেবে ২৭ লাখ টনের মত তরমুজের উৎপাদনের কথা জানিয়েছে। যা গত বছর সারাদেশে সর্বমোট উৎপাদনেরও বেশি এবং দক্ষিনাঞ্চলে গত বছরের চেয়ে প্রায় ১০ লাখ টন বাড়তি বলে জানা গেছে। যা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ বলে জানা গেছে।
নদ-নদীবহুল দক্ষিনাঞ্চলের নোনা পানিমক্ত চরাঞ্চলের পলি মাটিতেও তরমুজের ভাল আবাদ ও ফলন হচ্ছে। প্রায় মাস খানেক ধরেই পরিপক্ক-সুমিষ্ট তরমুজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। এমনকি দক্ষিণাঞ্চলের তরমুজ সড়ক ও নৌপথে সারা দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্ষজীবী, দিবস দৈর্ঘ্য, নিরপেক্ষ ও লতানো প্রকৃতির কুমড়া পরিবারের গাছ থেকে সুমিষ্ট রসালো ফল তরমুজ উৎপাদন হয়ে থাকে। মূলত ৫.৫ থেকে ৭.০ পিএইচ মাত্রার জমি সুমিষ্ট তরমুজ আবাদের ও উৎপাদনের জন্য উপযোগী হলেও কোন অবস্থাতেই তা অতিরিক্ত লবনাক্ততা সহ্য করতে পারেনা। পাশাপাশি খরা প্রতিরোধক ফসল তরমুজ অপেক্ষাকৃত শুষ্ক পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেও বৃষ্টির অভাবে এর উৎপাদন ব্যাহত হবার আশংকা থাকে। আবাদ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত ৩-৪টি সেচ প্রয়োগ করতে হলেও অতিবর্ষণ এর গাছ ও ফলকে ধ্বংস করে দেয়।
উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়িয়ে সুমিষ্ট রসালো ফল তরমুজ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ইতোপূর্বেই। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া এবং বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই তরমুজের আবাদ হলেও বাংলাদেশে ইতোমধ্যে এর আবাদ ও উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। যার সিংহভাগ অর্জনই দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের।
আমাদের কৃষি গবেষনা ইনষ্টিটিউট-বারি’র বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল সুমিষ্ট তরমুজের জাত উদ্ভাবন করেছেন। চলতি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজের হেক্টর প্রতি ফলন ৪২ টনের মত বলে ডিএই জানালেও ‘বারি’ নির্দেশিত সুষম সার প্রয়োগ সহ আবাদ কৌশল অনুসরন করলে উৎপাদন সহজেই ৫০ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলেও মনে করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। দক্ষিণাঞ্চলেও মৌমাছির সাহায্যে পরাগায়িত হয়ে এ ফলের উৎপাদন নিশ্চিত হলেও সুদূর অতীত থেকে ‘পতেঙ্গা’ ও ‘গোয়ালন্দ’ জাতের কালচে এবং নীলাভ গোলাকৃতির তরমুজের আবাদ হতো। তবে তার মিষ্টতা বর্তমান প্রজন্মর চেয়ে কম ছিল। অধিক ফলন, মিষ্টতায় পরিপূর্ণ আধুনিক রসালো জাতের তরমুজের জনপ্রিয়তা আমাদের দেশেও ক্রমে বাড়ছে।
বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলে ইউরোপীয়, প্রাচ্য ও গ্রীষ্ম মন্ডলীয় ‘টপইল্ড, গ্লোরী, কঙ্গো, চার্লসটনগ্রে, ইমিরিয়েল, জুবলী, সুপার ডেলিকেট, সুপার বেবী, সুইট ফেস্টিবল ও ফ্লোরিডা জয়েন্ট’ নামের একাধিক উন্নত জাতের তরমুজের আবাদ হচ্ছে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply