এস এল টি তুহিন, বরিশাল : বরিশালের বিলাঞ্চলে কারেন্ট জাল ব্যবহারের চেয়েও ভয়াবহ আকারে বেড়েছে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারি জাল। এতে দেশীয় মাছসহ জলজ জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকিতে পড়েছে। চায়না থেকে আমদানি করা অবৈধ দুয়ারি জালে ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। ওই জালে ৭০ পদের জলজপ্রাণী ধ্বংস হচ্ছে বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।
বরিশাল জেলায় চায়না দুয়ারী জাল পেতে অবাধে মাছ নিধন করা হচ্ছে। এতে জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে সাপ, কুইচা, কাঁকড়া, ব্যাঙ, শামুকসহ অধিকাংশ জলজ প্রাণী। এ থেকে মুক্তি পেতে দুয়ারি জাল আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন পরিবেশবাদীরা।
গত ২ দিন সরজমিনে বাকেরগঞ্জ ও বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ বিলে পাড়ের আইচার গ্রাম বালিয়ারচর, কাশিপুর, কাউয়ারচর, বাকেরগঞ্জের শিয়ালঘুনী চর,শতরাতরাজচর,গ্রাম এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ মাঠ, ডোবা, নালা, খাল সব জায়গাতেই চায়না দুয়ারী জাল পেতে মাছ ধরছেন জেলেরা। বেশিরভাগ জালে মাছের চেয়ে অন্যান্য জলজ প্রাণীই আশঙ্কাজনকহারে মারা পড়ছে। বরিশালের অঞ্চলের মৎস্য চাষিরাও চায়না দুয়ারী জাল নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এই জাল পুকুরে পেতে রেখে দু থেকে তিন দিনের মধ্যে এক পুকুরের প্রায় সব মাছ সাবাড় করে দেওয়া সম্ভব।
চায়না দুয়ারি জাল ব্যবহারকারী বরিশালের শায়েস্তাবাদ খোকন ঘরামী জানান, ওই জালের ফাঁস খুব ছোট, জাল অনেক শক্ত। ছোট আকারের মাছ থেকে শুরু করে যেকোনও জলজপ্রাণী জালে আটকে যায়। এ কারণে ওই জালের প্রতি ব্যবহারকারীদের আগ্রহ বেশি। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ডোবা-নালা, খাল ও নদীতে ওই জাল দিয়ে মাছ শিকারের ধুম পড়ে। মৎস্য কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জাল ব্যবহার করা হয়। তবে বরিশাল সদর উপজেলার একাধিক গ্রামে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দুয়ারি জাল ধ্বংস করেছে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি এর ব্যবহার। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাড়িতে বসেই জাল বিক্রি করছেন।
বরিশালের সরকারী ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মতিয়ার রহমান বলেন, অবৈধ জাল ব্যবহারের কারণে মাছের রেণুপোনা ধ্বংসের পাশাপাশি ৭০ প্রকার জলজপ্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। পানিতে বসবাসকারী ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে বড় প্রাণীরা খেয়ে বেঁচে থাকে। এখন ছোট প্রাণীগুলো যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে বড় প্রাণীগুলোও ধ্বংস হয়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে জনজীবনে। তিনি আরো বলেন, জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। এ জন্য তৃণমূল পর্যায়ে মৎস্য আইনের সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি অবৈধ জাল আমদানি বন্ধ এবং দেশে উৎপাদনকারী কারখানাগুলো ধ্বংস করা হলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।
বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ জাতীয় আওয়ামী লীগ মৎস্য সভাপতি বালিয়ার চরের গ্রামের নুর আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে খালবিল থেকে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। কিন্তু বর্তমানে চায়না জাল প্রকৃত মৎস্যজীবীদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জালের বিস্তাররোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে খাল-বিলে কোনো মাছ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জানা গেছে, বরিশাল সদর উপজেলা সহ বাকেরগঞ্জ, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর ও গৌরনদী উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে চায়না দুয়ারি জাল। গ্রামীণ হাটবাজারগুলোয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব জাল বিক্রি করেছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। ছোট থেকে বড় সব ধরনের মাছ এ জালে আটকা পরায় মৎস্যজীবীদের কাছে চায়না দুয়ারি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
আরো জানা যায়, চায়না জালের দুপাশে দুহাত পর পর লোহার তৈরি গোল রিং পড়ানো থাকে। তার মাঝখানে এক হাত পর পর ৩০ টির মতো চারকোনা রিং পড়ানো। চারকোনা রিংয়ের মাঝে একটি করে দুয়ার রয়েছে। এসব দুয়ার দিয়ে মাছ ও জলজ প্রাণী একবার ঢুকে পড়লে বেড় হতে পারেনা। এই জালের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো পানির তলদেশে লম্বালম্বিভাবে পড়ে থাকে। ফলে কোন প্রকার খাদ্য দ্রব্য ছাড়াই দুই দিক থেকে মাছ ও জলজ প্রাণী জালের ভেতরে ঢুকে পড়ে। চায়না দুয়ারী জাল দেখতে অনেকটা ঢলুকের মতো। এই জাল অনেকের কাছে ঢলুক জাল নামেও পরিচিত।
আগৈলঝাড়া উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলম বলেন, বর্ষা মৌসুমে খাল, বিল, ডোবা-নালাসহ যেখানে পানি জমে সেখানেই দেশীয় মাছের উৎপাদন বেড়ে যায়। আর এ সুযোগ নেয় কিছু মৌসুমি মাছ শিকারি। তারা অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে জলজপ্রাণী ধ্বংস করে ফেলছে। এ জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে একাধিকবার অভিযানও পরিচালিত হয়েছে। ওই সময় হাজার হাজার মিটার দুয়ারিসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। কারণ, জাল পেলেও ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। জলজপ্রাণী রক্ষায় অবৈধ জালের ব্যবহারে বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন বলেও জানান তিনি।
সরকারি সৈয়দ হাতেমালী কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক আরিফুল ইসলাম জানান, চায়না দুয়ারী জালে দেশীয় প্রজাতির সব মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী ধরা পড়ছে। এর মধ্যে বিপন্ন প্রজাতির অনেক মাছ ও জলজ প্রাণীও রয়েছে। জেলেরা মাছ ও কুইচা বিক্রি করছেন। এরপর সাপ, কুইচা, কাঁকড়া, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুকসহ অধিকাংশ জলজ প্রাণীই তারা মেরে ফেলছেন। ফলে সেসব মাছ ও জলজ প্রাণী বংশ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না। চায়না দুয়ারী জাল কারেন্ট জালের চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর।
গৌরনদী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল বাসার বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় ২০২১ জুলাই থেকে ২০২২ জুন পর্যন্ত ১৪টি অভিযান পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ জাল ধ্বংস করা হয়েছে। সর্বশেষ গত শনিবার দুপুরে উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের মাগুরা স্টিল ব্রিজ ও দোনারকান্দি এলাকা থেকে পাঁচ হাজার মিটার অবৈধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। একইভাবে অবৈধ জাল বিক্রির অভিযোগে পেলে সেখানেই অভিযান চালানো হয়।
এ ব্যাপারে বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা ইলিশ বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ইতোমধ্যে উপজেলার একাধিক বিলে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি চায়না জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। পাশাপাশি মৎস্যজীবীদের সচেতন করে তোলা হচ্ছে।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, দেশীয় প্রজাতির মৎস্যসম্পদ রক্ষায় প্রতিটি উপজেলায় অভিযান চালানোর জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযান চালানো হচ্ছে কিনা তা তদারকিও করা হচ্ছে। বাজারগুলোতেও অভিযান চলছে। তবে প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কেবল অভিযান চালিয়ে অবৈধ জালের ব্যবহার রোধ করা যাবে না। এ জন্য জনগণকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বরিশালের সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনিরুজ্জামান বলেন, নিষিদ্ধ চায়না জাল বিক্রি বন্ধে হাটবাজারগুলোয় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া যাতে কোনো ব্যবসায়ী এ জাল বিক্রি করতে না পারে সেজন্য মৎস্য কর্মকর্তাদের নজরদারি বাড়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply