মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৩:০৫ পূর্বাহ্ন

বিডি থাই ফুডের ৩.৩৯ কোটি টাকার জমিতে মাটি ভরাট ১২.৭৪ কোটির

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : সোমবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২২

অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব গ্রহনের শুরুতে অনেক কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদন বাতিল করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরী করেছিলেন। যার পেছনে অযৌক্তিক উন্নয়ন ব্যয় একটি কারন ছিল। তবে তার নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার জমিতে ১২ কোটি ৭৪ লাখ টাকার মাটি ভরাটবাবদ উন্নয়ন ব্যয় দেখিয়ে অর্থ তুলে নিচ্ছে বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। অথচ গণপূর্ত অধিদপ্তরের দর অনুযায়ি ওই জমি ভরাটে সর্বোচ্চ ৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে।

আইপিওতে আসার আগে ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারীজ, মজুদ পণ্যসহ বিভিন্নভাবে কোম্পানির সম্পদ বাড়িয়ে দেখানো নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এরমাধ্যমে উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা কোম্পানিতে তাদের শেয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে নেন। যে কারনে আইপিওতে আসার পরে বিভিন্ন কোম্পানির রুগ্ন হওয়ার পেছনে এটি একটি কারন হিসেবে থাকে। এই পরিস্থিতি উত্তোরনের আশার আলো দেখা দিয়েছিল শিবলী কমিশনের দায়িত্ব গ্রহনের মধ্য দিয়ে। যে কমিশন জমির তুলনায় বেশি দেখানো উন্নয়ন ব্যয়কে অযৌক্তিক বিবেচনায় আইপিও বাতিল করে দিয়েছিল। এমনকি জমির ক্রয় মূল্যের তুলনায় বাজার দর বেশি থাকা এবং রিভ্যালুয়েশন সারপ্লাস না থাকা সত্ত্বেও এমনটি করে।

কিন্তু বিডি থাই ফুড কর্তৃপক্ষ ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার জমিকে রিভ্যালুয়েশন সারপ্লাস হিসেবে আরও ৯ কোটি ৬৪ লাখ দেখানোর পরেও ১২ কোটি ৭৪ লাখ টাকার উন্নয়ন ব্যয় দেখিয়েছে। তারপরেও আইপিও অনুমোদন পেতে কোন সমস্যা হয়নি।

সাধারনত প্রকৃত ক্রয় মূল্যের তুলনায় জমির রেজিস্ট্রি দর কম হওয়ায়, অনেকেই ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টবাবদ সম্পদ দেখায়। তবে বিডি থাই ফুড কর্তৃপক্ষ যদি প্রকৃত ক্রয় মূল্যের চেয়ে রেজিস্ট্রি দর কম দেখিয়েও থাকে, তারা পূণ:মূল্যায়নের মাধ্যমে সেই দর বাড়িয়ে পূরণ করে নিয়েছে। তারপরেও তারা জমির চেয়ে মাটি ভরাটবাবদ ল্যান্ড ডেভেলপম্যান্ট বেশি দেখিয়েছে।

প্রসপেক্টাসের ৬৯ পৃষ্টানুযায়ি, বিডি থাই ফুডের ঢাকা ধামরাইয়ের নারায়নপুর ১১-১৬ সাল পর্যন্ত কেনা ৪৫২.২৫ শতাংশ বা ১৩.৫৭ বিঘা জমি রয়েছে। যার দলিল মূল্য ও রেজিস্ট্রি ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই মূল্যের জমিতে মাটি ভরাট, লেভেলিং ও ড্রেসিংবাবদ সম্পদ দেখানো হয়েছে ১২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ জমির থেকে কয়েকগুণ বেশি মাটি ভরাট বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে। যেখানে বিঘাপ্রতি জমিতে মাটি ভরাটে ব্যয় হয়েছে ৮৭ লাখ টাকার বেশি।

কিন্তু গণপূর্ত অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের দর অনুযায়ি, ওই ৪৫২.২৫ শতাংশ জমি ১২ ফিট গর্ত ভরাটে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। তাদের হিসাব অনুযায়ি প্রতি ঘনমিটারে পরিবহনসহ সর্বোচ্চ ৬২২ টাকা ব্যয় হতে পারে। এ হিসেবে বিডি থাই ফুডের ৪৫২.২৫ শতাংশ জমি ১২ ফিট গর্ত হিসাবে হয় ৬৬৮৯৪.৩২ ঘনমিটার। যা মাটি ভরাটে প্রতি ঘনমিটার ৬২২ টাকা করে ৪ কোটি ১৬ লাখ ৮ হাজার ২৬৮ টাকা ব্যয় হতে পারে।

এদিকে জমির ক্রয় মূল্য (রেজিস্ট্রি ব্যয়সহ) ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং জমি উন্নয়ন (ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) বাবদ ১২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বিবেচনায় মোট হয় ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। কিন্তু ৩৪৬ পৃষ্টায় স্থায়ী সম্পদের সিডিউলে ২৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে ৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকার জমি ও জমি উন্নয়নবাবদ সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছে। যেখানে পূণ:মূল্যায়নজনিত সারপ্লাস হিসেবে আরও ৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পৃথকভাবে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার জমি এখন ৩৪ কোটি ২১ লাখ টাকা।

তারপরেও কোম্পানিটির ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কাজ শেষ হয়নি। এবার আইপিওর মাধ্যমে টাকা নিয়ে ১০৪ শতাংশ জমি মাটি ভরাট, ড্রেসিং ও লেভেলিং করতে চায়। যার জন্য ব্যয় হবে ১ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির বাকি ৩৪৮.২৫ শতাংশ জমি উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এ হিসেবে পূর্বের ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টে ব্যয় বেশি হয়েছে।

এদিকে বিডি থাই ফুড কর্তৃপক্ষ ইপিএস ও শেয়ারপ্রতি নগদ পরিচালন প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হিসাবে গরমিল তথ্য দিয়েছে। তারা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইস্যুকৃত শেয়ারের বিপরীতে অর্থ সংগ্রহ করলেও তা ওয়েট না করেই মোট শেয়ার বিবেচনায় ইপিএস ও এনওসিএফপিএস গণনা করেছে।

দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরুতে পরিশোধিত মূলধন ছিল ৩৬,৫০,০০০০০ টাকার এবং শেয়ার মানি ডিপোজিট ছিল ১,২৫,২৫০০০ টাকার। যে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ওই অর্থবছরের শেষের দিকে (২৭ মে ১৮) ৩০ কোটি টাকার শেয়ার ইস্যু করেছে। এরমধ্যে যদি পূর্বের বছরের ১,২৫,২৫০০০ টাকার শেয়ার মানি ডিপোজিট থাকে, তাহলেও নতুন অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে ২৮,৭৪,৭৫০০০ টাকার। এই অবস্থায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ইপিএস ও এনওসিএফপিএস গণনায় শেয়ার ওয়েট করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৩৫১ পৃষ্টা অনুযায়ি তারা তা করেনি।

প্রসপেক্টাসে না দেখালেও কোম্পানিটির ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আর্থিক হিসাবে শেয়ার ওয়েট করে ইপিএস হিসাব করতে দেখা গেছে। যেখানে তারা ওই অর্থবছরে ওয়েটেড শেয়ার বিবেচনায় ১.৩১ টাকা ইপিএস দেখিয়েছে। কিন্তু এনওসিএফপিএস গণনায় ওয়েটেড শেয়ার বিবেচনায় নেয়নি।

বিডি থাই ফুড কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান সক্ষমতার নামমাত্র উৎপাদন ও বাজারজাতকরন করতে পারছে। তারপরেও সেই কোম্পানি মেশিনারীজ ও ইক্যুপমেন্ট কেনার জন্য শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করতে যাচ্ছে।

প্রসপেক্টাসের ৬৫ পৃষ্টানুযায়ি, কোম্পানিটির ৫টি খাতের পণ্যের মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জুস ও ড্রিংকস ক্যাটাগরিতে সংক্ষমতার মাত্র ০.৫৮% উৎপাদন করেছে। এছাড়া মিনারেল ওয়াটার ক্যাটাগরিতে ০.০০%, সফট ড্রিংকসে ০.৫১%, কনফেকশনারিতে ২৩.৫৯% এবং বেকারি ও অন্যান্যতে ৫৬.৮৩% উৎপাদন করেছে।

বিডি থাইয়ের প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারীজ ক্রয়ের সিডিউল অনুযায়ি, প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারীজের আয়ুস্কাল ২০ বছর। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে ৫% হারে ৪০ বছর মেয়াদে অবচয় চার্জ করছে। এতে করে প্রতিবছর ব্যয় কম দেখিয়ে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখানো হচ্ছে।

এদিকে ৮৫ পৃষ্টা অনুযায়ি, কোম্পানিটির জন্য মোট ৪৮ কোটি ৯৭ লাখ ২১ হাজার টাকার প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারীজ কেনা হয়েছে। যার অবচয় শেষে বুক ভ্যালু রয়েছে ৪২ কোটি ২৯ লাখ ৮ হাজার টাকা।

কিন্তু ৩৪৬ পৃষ্টায় স্থায়ী সম্পদের অবচয় সিডিউলে ৫৫ কোটি ১১ লাখ ২৭ হাজার টাকার প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারীজ ক্রয় এবং বুক ভ্যালু হিসেবে ৪২ কোটি ৯৮ লাখ ৩১ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।

গত ৫ বছরের আর্থিক হিসাব অনুযায়ি, বিডি থাই ফুডের শেয়ারপ্রতি মুনাফা কখনো ১ টাকা স্পর্শ করতে পারেনি। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইপিএস হয়েছে ০.৬৫ টাকা। ব্যবসায় এই দূর্বল কোম্পানিটিকে আইপিও দিয়েছে বিএসইসি। যে দূর্বলতার কারনে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের লভ্যাংশে নিষেধাজ্ঞার শর্তে আইপিও দিয়েছে।

এসব বিষয়ে বিডি থাই ফুডের সিএফও মো. সাহানুর রহমান ও সচিব হাবিবুর রহমান বিজনেস আওয়ারকে বলেন, ১০-১২ ফিট গর্ত ভরাট ও দূর থেকে মাটি আনতে হওয়ায় জমি উন্নয়ন ব্যয় বেশি হয়েছে। আর ক্রয় মূল্য, রেজিস্ট্রি মূল্য ও জমি উন্নয়নের থেকে ৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। পরে জানাবেন বললেও জানাননি।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের আর্থিক হিসাবে শেয়ার ওয়েট করে ইপিএস গণনা করলেও প্রসপেক্টাসে এসে না করার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি সিএফও এবং সচিব। এছাড়া ওই আর্থিক হিসাবেও ইপিএসের ন্যায় শেয়ারপ্রতি নগদ পরিচালন হিসাবে ওয়েটেড শেয়ার না নেওয়ার ব্যাখ্যা দেননি।

প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারীজের ক্রয় সিডিউল ও স্থায়ী সম্পদের সিডিউলের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে তারা বলেন, ক্রয় সিডিউলে সর্বশেষ ২০১৮ সালের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এরপরে কেনা হলেও তা ক্রয় সিডিউলে যোগ না করায় এমনটি হয়েছে।   

ব্যবসায় মুনাফা বাড়তে শুরু করার পরে করোনার আঘাতের কারনে ইপিএসে মন্দাবস্থা বলে জানান তারা। তবে বর্তমান ম্যানেজমেন্ট এখান থেকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে।

এ কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে- বিএলআই ক্যাপিটাল এবং ইউনিক্যাপ ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

উল্লেখ্য ২০১৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসা শুরু করা বিডি থাই ফুডের ব্র্যান্ড নাম ‘নেকটার’। যে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সারাদেশে ২৬০ ডিলারের মাধ্যমে জুস, ললিপপস, শরিষার তেল, আটা, ময়দা, সুজি,চানাচুর, কেক, পানি, হার্ড কেন্ডি, সফট কেন্ডি ইত্যাদি বাজারজাত করে বলে প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করেছে। এমনকি আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও বিডি থাই ফুডের পণ্য রপ্তানি করা হয়। যে কোম্পানির প্রতিযোগী ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে- প্রাণ, আকিজ, পারটেক্স, সিটি, এসিআই, কোকোলা, অলিম্পিকের মতো কোম্পানিগুলো।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS