 
																
								
                                    
									
                                 
							
							 
                    নিজস্ব প্রতিবেদকঃ প্রায় দুইশত বছর আগে ব্রিটিশ আমলে ১৮শ শতাব্দীতে চা-বাগান, পৌরসভা ও রেলওয়েতে কাজের জন্য ব্রিটিশরা পর্যাপ্ত দক্ষ বাঙালী শ্রমিক না পেয়ে দক্ষিন ভারতীয়দের নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে প্ররোচিত করে তেলেগু সম্প্রদায়কে এদেশে নিয়ে আসে। শহর পরিচ্ছন্নতা কাজে বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় তারা বসবাস করে আসছে। ১৮৮২ সালে একটি এনজিওর মাধ্যমে টিকাটুলী থেকে তাদের সায়েদাবাদ হুজুরবাড়ী এলাকায় আনা হয়। পরে হুজুর বাড়ীর জায়গাটি এরশাদ সরকার লিখে দিয়ে ১৯৯০ সালে সরকারিভাবে তাদের ধুলপুরে আনা হয়। যা পরবর্তীতে মেথর কলোনী নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানে একটি শিব মন্দির গলগাথা ব্যাপটিস্ট চার্চ ও চার্চ অফ ক্রাইস্ট নামে দুটি চার্চ ও উপসানালয় এবং ‘আউটফল তেলেও কমিউনিটি স্কুল একটি স্কুল রয়েছে। অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তেলেগু শিশুরা তেলেগু ও বাংলা ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে।
বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনে কাজ করা এবং সিটি কর্পোরেশনে কাজ করেনা মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি পরিবার এখানে রয়েছে। তার মধ্যে যারা সিটি কর্পোরেশনে কাজ করে তারা শিমুল’ ও ‘মুকুল’ এই দুই ভবনে মোট ৬০টি করে মোট ১২০টি পরিবার বসবাস করে। কিন্তু এখানেও কথা রয়েছে, কখনও কখনও তাদের হঠাৎ করে চাকুরিচ্যুত করে তাদের একদিনের নোটিশে বাড়ী থেকে বের করে দেয়া হয়। এছাড়া বাকী ১৩০টি পরিবার যারা সিটি কর্পোরেশনে কাজ না করলেও ব্যক্তিগতভাবে সুইপারের কাজ করেন নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। যদিও সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার পাবার কথা তথাপি তারা ব্যতিত অন্য বর্ণের লোক সেখানে নিয়োগ পাচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে কলোনী উচ্ছেদ ও সুইপারদের পুনর্বাসনের কথা বলছে। মেয়র ফজলে নুর তাপস তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পুনর্বাসন না করে আশেপাশের অন্যান্য অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হলেও তাদের কলোনী ভাঙ্গা হবেনা। কিন্তু গত ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখ তাদের ২দিনের মধ্যে ঐ এলাকা খালি করে দেবার নির্দেশ দেয় এরপর স্থানীয় কাউন্সিলর ও থানার ওসি একই নির্দেশ দেন। একথা ছড়িয়ে পড়লে কলোনী জুড়ে উচ্ছেদ আতংক ছড়িয়ে পড়ে এবং ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখ অসহায় দৃষ্টিতে দেখছিল আশেপাশের কলোনী ভাঙ্গার কাজ। অসহায় এই মানুষগুলো প্রশ্ন করছে, বিনা নোটিশে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? তারা বলেন এই ডোবাকে আমরা সোনার বাংলা বানিয়েছি আর এখন তা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। যদিও বস্তি উচ্ছেদ মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে পুনর্বাসন ছাড়া কোন বস্তি বা কলোনী উচ্ছেদ করা যাবে না। কারণ সংবিধানে জনগনের বাসস্থানের অধিকার রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। সেই সাথে সুপ্রীম কোর্ট অভিমত দেয় যে বাস্তস্থানের অধিকার তার জীবন ধারনের অধিকারের সামিল যা আমাদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তাই এখানে বৈধভাবে বসবাসরত পরিচ্ছন্ন কর্মীদের উচ্ছেদ হবে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বেলা । নিজেরা করি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মানবাধিকার সংরক্ষন পরিষদ ও এএলআরডিসহ বিভিন্ন নাগরিক সংস্থার প্রতিনিধিরা ঐ এলাকা পরিদর্শন করেছি, ভুক্তভোগী পরিবারগুলির দুর্ভোগ-দুরাবস্থা স্বচক্ষে দেখে এসেছি, তাদের সাথে কথাও বলেছি। আজকেও তাদের প্রতিনিধিরা এখানে আছেন।
“আউটফল তেলেগু কমিউনিটি ভুল এ কলোনীর ২০০ শিশু নিয়মিত পড়াশুনা করে। উচ্ছেদ করলে এ সকল শিশুর শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত বা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ এ কলোনীর শিশুরা বাইরের ভুলে পড়তে গেলে মেঘরের সন্তান আখ্যা দিয়ে তাদের সাথে কেউ মিশতে চায়না, এক বেঞ্চে বসতে চায়না। কখনও কখনও তাদের মেঘরের সন্তান হিসেবে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করে থাকে। যদিও তারা মুলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, ব্রিটিশ সরকার ভারতে তেলেঙ্গানা রাজ্য থেকে তাদেও পূর্বপুরুষদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল ‘জাত সুইপার’ হিসেবে কাজ করাতে। কিন্তু সুইপার হিসেবে এ অঞ্চলে আনা হলেও তাদের এখন সবাইকে চাকুরি দেয়া হচ্ছে না। বরঞ্চ অন্য পেশার লোকজনকে সুইপার হিসেবে চাকরি দেয়া হচ্ছে ফলে তাদের জীবনে বিড়ম্বনার শেষ নেই। আবার তারা অন্য পেশায়ও যেতে পারছেনা। কেউ তাদের অন্য কোন কাজ দিতে চায়না। তারা অভিযোগ করেন, ১৯৯০ সালে যখন আমাদের এ অঞ্চলে আনা হয় তখন এ জায়গা ডোবা ছিল। সিটি কর্পোরেশনের ময়লা এখানে ফেলা হতো। আমরা সে ডোবাকে সোনার বাংলা বানিয়েছি। এখন আমাদেরকে এ জায়গা থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখ যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মসর্তা এলাকার মাতাব্বরদের ডেকে নিয়ে বলেন, সিটি কর্পোরেশন যে নির্দেশনা দেবে তা তাদের অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। এর বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিবাদ, মনাববন্ধন চলবে না বা কাউকেও এ বিষয় কোন কিছু বলা যাবে না।’
তারা অভিযোগ করেন হঠাৎ আমাদের ডেকে নিয়ে দু’দিনের মধ্যে কলোনী ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা কোথায় যাব? অত্র এলাকায় কেউ তাদের মেথর বলে বাসা ভাড়া দিতে চায়না। সবার জীবনের ঠিকানাতো এখানেই। জাতীয় পরিচয়পত্রে কলোনিই আমাদেও স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ হোক, তা চাই না। আর পুনর্বাসন করা হলে এক জায়গায়ই সবাইকে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় উক্ত এলাকা পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, এ তেলেগু সম্প্রদায়কে যথাযথ পুনর্বাসন না করে এ এলাকা থেকে উচ্ছেদ হবে মানবাধিকার লংঘন। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত উচ্ছেদ না করার আহবান জানিয়েছেন।
তাই উচ্ছেদ আতংক পীড়িত তেলেগু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানো আজ সচেতন দেশবাসীর একান্ত কর্তব্য আমরা সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকদের পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত দাবিগুলি সরকারের কাছে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য তুলে ধরছি-
১. কোন অবস্থায়ই তেলেগু কমিউনিটি জাত সুইপার কলোনীর বাসিন্দা পরিচ্ছন্নকর্মীদের যথাপোযুক্ত পুনর্বাসন ব্যতিত উচ্ছেদ করা হবে না মর্মে ঢাকা (দক্ষিন) সিটি কর্পোরেশন থেকে এখনই স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিতে হবে।
২. পূর্বে যেহেতু এই পরিবারগুলি একাধিকবার স্থানচ্যুত হয়েছে তাই বর্তমান পুনর্বাসন স্থায়ীভাবে হতে হবে। এবং উক্ত জমির মালিকানার বৈধ কাগজপত্র তাদের নিকট হস্তান্তর করতে হবে।
৩. কোন অবস্থায়ই উক্ত এলাকার আউটফল তেলেও কউিনিটি স্কুলটি উচ্ছেদ করা যাবে না, জাতীয় শিক্ষানীতির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ স্কুলটিকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় স্থায়ীভাবে পরিচালিত করতে হবে কারণ এখানে বাংলার পাশাপাশি তেলেগু ভাষায় সুইপার সম্প্রদায়ের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগেই এই ঘোষণাটিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে দেবার জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি।
৪. তাদের ২টি গীর্জা এবং একটি শিব মন্দিরের যথাযথ সুরক্ষা দিতে হবে।
৫. যেহেতু তাদের এ এলাকায় আনা হয়েছে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে তাই এই সংক্রান্ত চাকুরীতে তাদের সবসময় অগ্রাধিকার দিতে হবে। চাকুরিরত বা চাকুরি হারা নির্বিশেষে আবাসানের সুযোগ এদের সকলকেই দিতে হবে। কাউকে চাকুরি নেই বলে উচ্ছেদ বা বাস্তচ্যুত করা যাবে না।
৬. সিটি কর্পোরেশন কিংবা পুলিশ থানা থেকে তাদেও বার বার উচ্ছেদেও যে হুমকি-হয়রানির কথা বলা হচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
৭. শুধু সিটি কর্পোরেশন নয় সরকারের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলতে চাই এই মহানগরকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচল, গতিশীল ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে তেলেও কমিউনিটিসহ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বাসযোগ্য আবাসনসহ নূন্যতম মানবিক সুবিধা ও সেবা নিশ্চিত করতেই হবে।
আয়োজনকারী সংস্থা সমূহ: বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষন, নিজেরা করি, টিআইবি, ব্লাস্ট, বেলা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, এএলআরডি ও ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী।
 
                                 
									Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply