বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন

শ্রমিক-মালিক এক হয়ে গড়বো এ দেশ নতুন করে: শ্রমিকদের বাস্তব অধিকার এবং সরকারের দায়িত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ প্রতি বছর আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আমাদের সামনে এমন একটি বার্তা নিয়ে আসে যা শ্রমিকদের মর্যাদা, অধিকার এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য লড়াইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০২৫ সালের এই দিবসে যে স্লোগানটি বিশেষভাবে আলোচিত—”শ্রমিক-মালিক এক হয়ে গড়বো এ দেশ নতুন করে”—তা একাধারে জাতীয় উন্নয়ন, অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায়ের আহ্বান বহন করে। তবে প্রশ্ন হলো, শ্রমিক-মালিকের এই ঐক্য শুধু কথার ভুবনে সীমাবদ্ধ, না কি বাস্তব ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন ঘটেছে?

বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি এখনো মৌলিক অধিকারের জন্য সংগ্রামরত। ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন, সংশোধিত ২০১৮ ও ২০২২ সালে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কিছু কাঠামো দিয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের কার্যকর প্রয়োগ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, কাজের নিরাপদ পরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা, ছুটি এবং চাকরির নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গার্মেন্টস, পরিবহন, নির্মাণ ও এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের হাজারো শ্রমিক ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, শ্রমঘণ্টা অমানবিক, নিরাপত্তা উপেক্ষিত এবং কোনো প্রতিকারহীনভাবে বরখাস্ত হচ্ছেন।

রেলওয়ে শ্রমিক ও পোষ্য কোটা: একটি ঐতিহাসিক অধিকার বিপন্ন
বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, যেখানে শ্রমিকদের অবদান কেবল দৈনন্দিন কার্যক্রম নয়, বরং জাতীয় সংহতি এবং পরিবহন অবকাঠামো গঠনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। এ প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘকাল ধরে চালু ছিল রেলওয়ে পোষ্য কোটা, যা ১৯৭০ সালের দিক থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এটি ছিল শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতির নিদর্শন, যার মাধ্যমে কর্মচারীদের পরিবার পরবর্তী প্রজন্মেও সরকারি চাকরির সুযোগ পেতেন।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত একটি গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং শ্রমিক পরিবারের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক আঘাত। শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য একটি আশ্রয়-নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যৎ, যা এই কোটা নিশ্চিত করত, তা এক ধাক্কায় অপসারিত হলে এটি শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের ন্যায্যতা ও মানবিক দায় অস্বীকার করার শামিল।

আইনগত ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই কোটা বহাল রাখা অপরিহার্য। সংবিধানের ১৫ (ক) ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের উপযুক্ত জীবিকা ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দানের জন্য দায়বদ্ধ। একই সঙ্গে, ২৯(৩) ধারা বলে যে, নির্দিষ্ট শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের অনগ্রসরতাকে দূর করতে হলে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সেই সূত্র ধরেই কোটা ব্যবস্থা, বিশেষ করে পোষ্য কোটা, একটি সংবিধানসম্মত সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উপায়।

সরকারের দায়িত্ব ও সম্ভাব্য করণীয়:
এই প্রেক্ষাপটে সরকারের দায়িত্ব শুধু নীতিমালা গ্রহণেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার ও তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রস্তাবিত করণীয় হতে পারে:
১. শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও আইন প্রয়োগে দৃঢ়তা:
শ্রম আইন ২০০৬-এর কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে শ্রম আদালত ও পরিদর্শক নিয়োগ আরও বাড়াতে হবে। বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিয়মিত অডিট ও মূল্যায়নের মাধ্যমে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২. রেলওয়ে পোষ্য কোটা পূর্ণমাত্রায় সংরক্ষণ ও আইনি রূপদান:
পোষ্য কোটাকে কেবল একটি প্রশাসনিক সুবিধা না বানিয়ে তা আইনগত অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিধান বাংলাদেশ রেলওয়ে নিয়োগ বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
৩. শ্রমিক ইউনিয়ন শক্তিশালীকরণ:
শ্রমিক সংগঠনগুলিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে আইন প্রণয়ন করতে হবে যাতে তারা স্বাধীনভাবে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। ইউনিয়নগুলোর প্রশিক্ষণ, তহবিল ও নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে।
৪. জাতীয় কর্মসংস্থান নীতির পুনঃমূল্যায়ন:
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটা পুনর্বহাল করতে হবে, যাতে তারা কেবল কোটার আওতায় নয়, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্যতা অর্জনের সুযোগও পায়।
৫. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ ও ILO কনভেনশন বাস্তবায়ন:
বাংলাদেশ  ILO (International Labour Organization)-এর ৮টি মূল কনভেনশনের সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে:

Convention 87: Freedom of AssociationConvention 98: Right to Organize and Collective Bargaining
সরকারকে এসব কনভেনশন পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়ন হয় এবং আইনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়।

শ্রমিকদের কষ্টার্জিত অর্জন ও ত্যাগ যদি রাষ্ট্রীয় নীতির মাধ্যমে মুছে ফেলা হয়, তাহলে জাতীয় উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকবে। “শ্রমিক-মালিক এক হয়ে” যে দেশ গড়ার কথা বলা হয়, তা বাস্তবে রূপ পাবে তখনই, যখন শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, পোষ্য কোটার মতো সুরক্ষা ব্যবস্থা বহাল এবং আইনি কাঠামোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে।

এখন সময় এসেছে রাষ্ট্র ও সমাজ একযোগে শ্রমিকদের প্রতি ন্যায্যতার বার্তা দিতে। আইন, নীতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সংমিশ্রণেই গড়ে উঠবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, শ্রমিকবান্ধব এবং মানবিক বাংলাদেশ।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS