বগুড়া: বগুড়ার জুবলি ইন্সটিটিউটের সপ্তম শ্রেণীর নাওয়াল তাবাসসুমের পরিবারের বসতভিটা ছিল সারিয়াকান্দির যমুনার চরে। দুই বছর আগে সব গেছে নদীগর্ভে। সব হারিয়ে এখন তাদের আবাস বগুড়ার হাড্ডিপট্টির টিনসেটের দুই রুম বিশিষ্ট এক ভাড়া বাসায়। পাঁচ সদস্যদের পরিবারের দিন এনে দিন খাওয়া নাওয়াল তাবাসসুমের দিনমজুর বাবা নাবিলই ভরসা। নদীপাড়ের বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের চিত্র ঠিক এমনই।
প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রভাবিত। তবে এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে শিশুদের। সেদিক বিবেচনা করে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে বিদ্যালয়গামী শিশু কিশোরদের মধ্যে সচেতনতা ছড়াতে এবং ভবিষ্যতে তাদেরকে “ক্লাইমেট চেঞ্জমেকার” হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করে “প্রজেক্ট হ্যালো”। এই প্রজেক্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতারা হচ্ছেন বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের স্নাতক পড়ুয়া নাজমুল, রাজিউল, রাকিবুল, সাকিবুল ও তামিম।
প্রজেক্ট হ্যালোর সহ প্রতিষ্ঠাতারা
বগুড়ার জুবলি ইন্সটিটিউট, ইনডিপেনডেন্ট মডেল স্কুল এন্ড কলেজ এবং চকসূত্রাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় দুই শত জন শিক্ষার্থীকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সচেতনতা ও ঝুঁকি মোকাবেলা সম্পর্কে জানানো ও তাদের সমন্বয়ে ‘হ্যালো ক্লাইমেট চেঞ্জমেকার ক্লাবে’র মাধ্যমে শুরু হয় তাদের কাজ।
পরিবেশ দূষণ হয় এরূপ পুরোনো ও ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতে পারে সে বিষয়ে প্রজেক্ট হ্যালোর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের জানানো মাধ্যমে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে থাকে ও সেইসব জিনিসপত্র ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে আসছে।
‘এক শিশু একটি পরিবর্তন’ স্লোগানে দূষণ রোধে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে কমপক্ষে একটি অভ্যাস পরিবর্তন করতে অঙ্গিকার করেন শিক্ষার্থীরা।
জুবলি ইন্সটিটিউটের অষ্টম শ্রেণির বুশরা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি জানতে পারেছি যে টিস্যু তৈরিতে অনেক গাছ কাটতে হয়। এতে বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে। আমি এখন রুমাল ব্যবহার করি ফলে কিছুটা আমি পরিবেশের জন্য সহায়ক হচ্ছি। আর আমি আমার সব সহপাঠীদের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কি কি হচ্ছে আর আমরা কি করবো তা নিয়ে আলোচনা করি’।
মুরাদ সরকার নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি আগে অব্যবহৃত কলম, বোতল, ব্রাশ, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ যেখানে সেখানে ফেলে দিতাম। এখন আমি ওগুলো দিয়ে নতুন নতুন জিনিস তৈরি করছি।কিছুদিন আগে একটা কলম দানিও তৈরি করেছি। আমার বন্ধুদেরও তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করছি ’।
রমজান মন্ডল নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ হ্যালো ভাইয়াদের কথা শোনার পর ও ক্লাবের মাধ্যমে আমি নিজেই সচেতন আর নিজের সহপাঠীদেরও সচেতন করছি। আমরা ভবিষ্যতে আমাদের সুন্দর পৃথিবীর জন্য কাজ করে যাবো’।
হ্যালোর প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের আরো অসংখ্য শিক্ষার্থীকে জলবায়ু সম্পর্কে সচেতন করছে “হ্যালো জলবায়ু ক্লাব” এর মাধ্যমে। যার ফলে পরিবর্তন আনতে শিশুর জন্য শিশু হচ্ছে সহায়ক। আর এর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সবুজ বাসযোগ্য ও শিশুর জন্য আগামী তৈরি করা।
এই কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে প্রজেক্ট হ্যালোর সহ প্রতিষ্ঠাতা তৌফিকুর রহমান তামিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘আমাদের প্রজেক্ট হ্যালো একটি পরিবেশ বিষয়ক অলাভজনক সংগঠন। যেখানে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে অর্থাৎ স্কুল শিক্ষার্থীদেরকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতন করি এবং তাদেরকে ভবিষ্যতের ‘ক্লাইমেট লিডার’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। আমরা এমন একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে চাই যে পৃথিবী হবে দূষণ মুক্ত, জলবায়ু উদ্বাস্তু মুক্ত। যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শান্তিতে ও নিরাপদে বাঁচতে পারবে’।
সহ প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ‘গ্রিন কর্ণার’ নামে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছি আমার এতে করে তাদের মধ্যে তাড়না কাজ করবে এবং আমরা আরো শিক্ষার্থীর মধ্যে এই সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবো ’।
তিনি আরো বলেন, ক্লাসরুমের ভেতর একটি স্থান নির্বাচন করে সেখানে গাছের জন্য জায়গা রেখে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির একটি উদ্যোগ এটি। তাছাড়া প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার না করা, শক্তির অপচয় রোধ, খাদ্য সচেতনতাসহ শিশুদের অধিকার সচেতনতাসহ আরও অনেক পরিবেশবাদী অঙ্গীকারের দেখা মিলবে এই গ্রিন কর্নারে রাখা পোস্টারগুলোতে।
শুধু অঙ্গীকারেই সীমাবদ্ধ নয় শিশুরা। অঙ্গীকার মেনে চলছে তারা, উদ্বুদ্ধ করছে পরিবারের সদস্যদের, খেলার সঙ্গীদেরও।
আরেক সহ প্রতিষ্ঠাতা সাকিবুল বলেন, ‘ আমরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই শিক্ষার্থীদের তদারকি করে থাকি যাতে করে তারা চর্চা করতে পারে। এছাড়া তাদের অভিভাবক সহ শিক্ষকদেরও আমরা সচেতন করবার চেষ্টা অব্যাহত রাখছি। এছাড়াও আমরা সোসাল এন্টারপ্রাইজ দাড়ানোর চেষ্টা করছি যার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রজেক্টকে এগিয়ে নিতে কাজ করছি’।
শিশুদের নিয়ে গঠিত ক্লাবের বিভিন্ন পরিবেশবাদী কাজগুলো করছে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পড়ুয়া শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে আছে সানিয়া, আতিকা, মুরাদ, রমজান, লাম, রাইসা, সাওদা, সামিহা, সামিয়া, সারা, রুযিতা, রুহি, নাযিবা, মোহনা, ধ্রুবা, বুশরা, রাইমাসহ আরও অনেকে।
জুবলি ইন্সটিটিউটের প্রধান শিক্ষক পলক কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভয়াবহ। সর্বশেষ কপ- এও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় শিশু ও তরুণদেরকে পরিবর্তনের ”এজেন্ট” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হ্যালো প্রজেক্টের মাধ্যমে শিশু শিক্ষার্থীদের এই চর্চা দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরিতে ভূমিকা পালন করবে’।
এছাড়া প্রজেক্ট হ্যালো –ব্যবহার করা চা’পাতা থেকে সার তৈরি, মাটির টবে গাছ রোপণ, জনসম্মুখে সচেতনতা ছাড়াও চায়ের দোকানে মাটির কাপ ব্যবহারেও উৎসাহী এবং নির্বিকার গাছকাটা রোধ ও যত্রতত্র ময়লা ফেলানোর কাজ থেকে বিরত রাখার কাজ করছে।
ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম ‘আমরা নতুন নেটওয়ার্ক’ এর ট্রেইনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে ১ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রজেক্ট হ্যালো দাড় করায় এই তরুণরা।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply