শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪২ অপরাহ্ন

আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইমামদের কর্তব্য ও করণীয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০২৩
  • ১৪৫ Time View

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত: মসজিদকে কেন্দ্র করেই সামাজিক নানা বিষয় আবর্তিত হয়। স্বভাবতঃই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মসজিদের প্রধান দায়িত্বশীল ‘ইমাম’ ও ‘খতীব সাহেবদের অবস্থান বেশ উপরে । সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে ইসলামী মূল্যবোধ বাস্তবায়নে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা অনস্বীকার্য। আর এই খোদায়ী সিলসিলার সূচনা সেই ‘আহদে নববী’ বা ‘নববী যুগ’ হতেই, স্বয়ং রাসূলে আত্মহার সা. এর মাধ্যমে। এবং তা আজ অবধি বিদ্যমান।

বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী এনায়েতুর রহীম ‘Rural Socity’ শীর্ষক নিবন্ধে গ্রামীণ সমাজের পরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, গ্রামীন সমাজ হচ্ছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংঘবদ্ধতা যা নিকট আত্মীয়তার চাইতে বড় পরিসর যেমন ধর্মীয় আচার, পারস্পরিক সুযোগ সুবিধার ভিত্তিতে গড়ে উঠে। এর সামাজিক বিধান ও শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রিত হয় স্থানীয় মসজিদ ও. মোল্লা দ্বারা।’ মূলত: এর মাধ্যমে এ কথার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যে, সামাজিক রীতিনীতি এবং মূল্যবোধ নিয়ন্ত্রনের মূল চাবিকাঠি। এখনো মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে এখনো বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাস গ্রামীন সমাজে। সে হিসেবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মসজিদের ইমাম ও খতীব সাহেবগণের স্বদিচ্ছা থাকলে এখনো এ দেশের মানুষের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা খুবই সম্ভব।

সমাজ বিজ্ঞানের পাঠক মাত্রই অবহিত আছেন যে, একজন মানুষের চিন্তা, মানসিকতা এবং মূল্যবোধ পরিগঠনে সর্বপ্রথম পরিবার ব্যবস্থা, অতঃপর সমাজ ব্যবস্থা, তারপর রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং পরিশেষে বিশ্ব ব্যবস্থা বা ওয়ার্ল্ড অর্ডার বিশেষ ভূমিকা রাখে। মূলতঃ এই চক্রের ভেতর দিয়েই মানুষের বিশ্বাস ও মানসিকতার কাঠামো গড়ে উঠে। এ চক্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তর হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। বরঞ্চ বলা চলে, সমাজ ব্যবস্থা তার পূর্বাপর উভয় স্তর তথা পরিবার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। তাই কোন উপায়ে যদি এই স্তরে গোছানো, পরিকল্পিত এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, তাহলে আমরা নববী যুগ হতে যে সিলসিলার সূচনা হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা যথাযথরূপে অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ!

বক্ষ্যমান নিবন্ধে আদর্শ সমাজ বিনির্মানে ইমাম ও খতীব হিসেবে আমরা কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারি, সে প্রসঙ্গে –

ধারাবাহিকভাবে কিছু আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ !

একজন ইমাম বা খতীব হিসেবে আমাদের করণীয় কী কী

ইমাম ও খতীব হিসেবে আমাদের অনেক কিছুই করণীয় রয়েছে। সংক্ষিপ্তাকারে এই নিবন্ধে ৫টি পয়েন্টে-

প্রথমত: মুসল্লী তথা সমাজের সামনে ইমাম ও খতীব সাহেব নিজেকে একজন আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলা। মুসল্লীদের মাঝে ইমাম ও খতীব সাহেবের ইতিবাচক ও সশ্রদ্ধ ভাবমূর্তি তাঁর কাজ অনেকটাই সহজ করে তুলবে। এজন্য ইমাম সাহেবের জন্য করণীয় হবে, মুসল্লী সমাজের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে কিংবা ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, এ জাতীয় কর্মকাণ্ড বা ইস্যু থেকে নিজেকে হেফাজত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

দ্বিতীয়ত: দৈনিক বয়ান, সাপ্তাহিক তাফসীর, জুমার বয়ান, ঈদ বা অন্য কিছু কেন্দ্র করে মুসল্লী সমাজের সামনে যখনই কোন বক্তব্য বা বয়ান পেশ করার উপলক্ষ্য তৈরী হবে, তখন আমাদের বক্তব্য হতে হবে তথ্যভিত্তিক, গোছানো, সুষ্পষ্ট, ভদ্রোচিত, পরিচ্ছন্ন ও প্রাঞ্জল। আমাদের বক্তব্যের মধ্যে কোনভাবেই ভুল তথ্য কিংবা আলপটকা মন্তব্য জাতীয় কথা থাকা বাঞ্চনীয় নয়। শস্তা জনপ্রিয়তার দিকে লক্ষ্য করে যদি আমরা এ জাতীয় চটুল বক্তব্য দেই, তাহলে হয়তো তাৎক্ষণীকভাবে আমরা জনপ্রিয়তা কামাতে পারবো, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখিন হব। এ জাতীয় কর্মকান্ড জনসাধারণের মাঝে ইমাম ও খতীব সাহেব তথা বৃহত্তর আলেম সমাজ সম্পর্কে এই ভুল বার্তা দিবে যে, উলামায়ে কেরাম কোন প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই নির্বিচারে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। সুতরাং তাদের বক্তব্য নির্ভরযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে অধুনা ইস্যুগুলোর মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ আমি দু’একটি দৃষ্টান্তের কথা এখানে উল্লেখ করবো।

১. ‘বিবর্তনবাদ’ ও ডারউইন : অল্প কিছুদিন আগেই এটি আমাদের মাঝে বহুল চর্চিত একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল । চার্লস রবার্ট ডারউইন ১৮৫৯ইং সালে প্রকাশিত তার ‘On the Origin of Species’ নামক বইতে ‘এভুলেশন থিউরি’ বা বিবর্তনবাদের স্বপক্ষে তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এই ‘এভুলেশন থিউরি’ বা ‘বিবর্তনবাদ’ সরাসরিভাবে আমাদের ইসলামী বিশ্বাসের বিরোধী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসলাম বিরোধী এই মতকে নাকচ করতে গিয়ে আমরা তাত্ত্বিক ও এ্যাকাডেমিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে শঙ্কা জনপ্রিয়তার বশবর্তী হয়ে নানা প্রকার এলোমেলো ও অকার্যকর যুক্তি প্রদর্শন করেছি। কখনো সখনো সেটা ভদ্রতার সীমাও লঙ্গণ করেছে। অবশ্য সংখ্যায় বিরল হলেও এর বিপরীত দৃশ্যও মাঝে মধ্যে দেখা গিয়েছে। তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র এবং অনুকরণীয়।

অথচ ডারউইনের এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক, যৌক্তিক অসাধারণ বেশ কিছু বক্তব্যও রয়েছে। যা দিয়ে এই মতবাদকে খুব সহজেই নাকচ করা যায়। উদাহরণস্বরুপ আমরা এখানে ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’কে তিনটি পদ্ধতিতে কীভাবে নাকচ করা যায়, তা দেখবো।

প্রথমত:, চার্লস রবার্ট ডারউইন ‘এভুলেশন থিউরি’ বা ‘বিবর্তনবাদ’- এর একমাত্র প্রবক্তা নন। আরোও অনেকেই এই মত প্রচার করেছেন। এই মতের প্রবক্তাদের মধ্যেই ‘বিবর্তনবাদ’ নিয়ে ইখতেলাফ বা মতদ্বৈধতা রয়েছে। যেমন: বিবর্তনবাদের আরেক বিখ্যাত প্রবক্তা হার্বাট স্পেপ্লারের মত ডারউইনের মতের সাথে মিলে না। তাদের মধ্যেই গুরুতর মতবিরোধ রয়েছে। ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’ ‘সারভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ এই ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়ানোঃ পক্ষান্তরে হার্বাট স্পেন্সারের ‘বিবর্তনবাদ’ ‘সারভাইবাল অফ দ্যা স্মার্টেস্ট’ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। অতএব, উপরোক্ত তথ্যের নিরিখে এ কথা বলাই চলে যে, সমাজ বিজ্ঞানের যে সুত্র বা মত নিয়ে তার প্রবক্তারাই এখন পর্যন্ত একমত হতে পারেনি, তা কোন সুনিশ্চিত এবং প্রমাণিত মতবাদ হতে পারেনা।

দ্বিতীয়ত:, ‘আনরিলায়েবল এভিডেন্স’ তত্ত্বের মাধ্যমেও ‘বিবর্তনবাদ’কে সহজেই নাকচ করা যায়। এই তত্ত্ব বলে, আজকের এই যুগে মাইক্রো বিজ্ঞান চরম উৎকর্ষতার স্তরে রয়েছে। আজ আমরা খুব সহজেই আমাদের শরীরের কোষের। মধ্যে যে কোন ধরণের পরিবর্তন বা বিবর্তন নিরীক্ষণ করতে সক্ষম। অথচ এই যুগেই একথা প্রমাণ করা যায়নি যে, আমাদের শরীরে ধীরে ধীরে কোন বিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সোজা কথা, ‘মাইক্রাবায়োলজি’ বা ‘অণুজীব বিজ্ঞান’ এর মাধ্যমেও ‘বিবর্তনবাদ’কে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। এ কারণেই পশ্চিমের অনেক বিজ্ঞানী ‘বিবর্তনবাদ’কে স্বীকারও করেননা। অতএব বোঝা গেল, ডারউইন তার এ মতের স্বপক্ষে যে প্রমাণ দিয়েছেন, তা রিলায়েবল’ বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুতরাং ‘আনরিলায়েবল এভিডেন্স’ বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণের অভাবে ‘বিবর্তনবাদ ও প্রমাণিত কোন সত্য নয় । তৃতীয়ত:, অসংখ্য এমন যুক্তি রয়েছে, যেগুলোর কোন সঠিক উত্তর ‘বিবর্তনবাদ’-এর প্রবক্তারা দিতে তো পারেনি, সেই সাথে সে সব যুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষের আগমন সম্পর্কে ইসলামী যে বিশ্বাস, তা-ই সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হয়। আমরা সেখান থেকে মাত্র ৫টি যুক্তির কথা এখানে তুলে ধরবো।

(১) মানুষই হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র জীব, যে প্রকৃতি থেকে সরাসরি খাবার গ্রহণ করতে পারে না। তাকে প্রসেস করে বা রান্না করে খাবার গ্রহণ করতে হয়। এই বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণী থেকে তাকে পৃথক করেছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, সে এমন এক জগত থেকে এসেছে, যেখানে প্রকৃতি থেকে সরাসরি খাদ্য গ্রহণ সে শিখেনি। এই যুক্তি দ্বারা মানুষের সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে আগমন সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বাসই প্রমাণিত হয়।

(২) মানুষকে চারপাশের প্রকৃতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হলেও পোষাক পরিধান করতে হয়। চরম গ্রীষ্ম বা তীব্র ঠান্ডার পরিবেশে তাকে টিকে থাকতে পোষাক পরিধান করতে হয়। যদি বিবর্তনবাদ সঠিকই হতো, তাহলে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের মানুষের শরীর সেখানকার আবহাওয়ার সাথে মানানসই হতো; তদ্রুপ শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষের শরীর সেখানকার আবহাওয়ার অনুকূল রোম দ্বারা আবৃত হতো। সোজা কথা, মানুষের শরীর অঞ্চল ভেদে, আবহাওয়া ভেদে রোমশ ও কিংবা রোমহীন হতো। বিবর্তনবাদ অনুসারে তা-ই হবার কথা। অথচ আমরা দেখি, পৃথিবীজুড়ে ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ার মানুষের শরীর এক ধরণেরই। অতএব, আমরা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা বলতেই পারি, ‘বিবর্তনবাদ’ সঠিক কোন মতবাদ নয়।

(৩) মানুষই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী, যে মেরুদন্ড সোজা করে নিরিবিচ্যিা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। বিবর্তনবাদে বলা হয়, মানুষ ‘হোমো ইরেক্টাস’ থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। এখন যদি বিবর্তনবাদ সঠিকই হতো, তাহলে আজকের এই যুগে আমরা মানুষের মতো আরো অনেক এমন জীব দেখতে পেতাম, যারা সোজা হয়ে একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। অথচ তা দেখতে পাওয়া যায় না। এ যুক্তি দ্বারাও বিবর্তনবাদের অসারতা প্রমাণিত হয় এবং মানুষ যে এ জগতের

কোন প্রাণী নয়, বরং ভিন্ন কোন জগত থেকে তাকে আনা হয়েছে, ইসলামী সেই বিশ্বাস সাব্যস্ত হয়। [৪] বিবর্তনবাদের মূল তত্ত্ব হচ্ছে ‘সারভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ বা সর্বাপেক্ষা সবলের টিকে থাকা। অথচ আমরা দেখি, ম্যামথ (অতিকায় হাতি) এবং জুরাসিক যুগের ডাইনোসরের মতো প্রাচীন কালের অনেক শক্তিশালী ও সবল প্রাণী কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। অথচ সারভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট তত্ত্ব অনুসারে মানুষের তুলনায় তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা ছিলো বহুগুনে বেশি এবং প্রাণীদের মধ্যে দূর্বল প্রজাতী মানুষ জাতি কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। বিবর্তনবাদের মূল তত্ত্বই বিবর্তনবাদের সাথে সাংঘর্ষিক। বরঞ্চ বিবর্তনবাদের এই তত্ত্বটি মানুষ যে এ জগতের নয়, বরং ভিন্ন কোন জগত থেকে এসেছে, তাই প্রমাণ করে। [৫] সবথেকে অব্যর্থ যুক্তিটি নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী প্রফেসর সালাম দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সকল প্রাণীর এ্যামাইনো এসিড তার শরীরের ডানদিকে বিক্ষিপ্ত হয়; আর মানুষই একমাত্র প্রাণী, যার এ্যামাইনো এসিড তার শরীরের বাম দিকে বিক্ষিপ্ত হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, মানুষকে পৃথিবীর বাহিরের অন্য কোন জগত থেকে আনা হয়েছে। এই তত্ত্বটি সম্পূর্ণই আমাদের ইসলামী বিশ্বাসকে সাব্যস্ত করে।

২. ফিতনায়ে ইরতিদান আমাদের সমাজে মিষ্টান মিশনারিজ, কাদিয়ানী জামাত, বাহাঈ ধর্মের লোকজনসহ আরোও বেশ কিছু ধর্মাবলাম্বী লোকজন নানা ভাবে মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মোটাদাগে তাদের কার্যক্রম দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত: ফিনান্সিয়াল ডিম’ বা আর্থিক পরিকল্পনা’; এ পরিকল্পনার অধীনে তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন বর্গীয়, দরিদ্র, বঞ্চিত ও অশিক্ষিত মানুষদেরকে তাদের শিকার বানাচ্ছে। তারা অর্থের লোভ দেখিয়ে মুসলমানদেরকে ধর্মত্যাগে বাধ্য করে। এইক্ষেত্রে আমাদের ইমাম ও খতীবদের উচিত জনসাধারণকে সচেতন করে সে সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতী কাজের ব্যবস্থা করা।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাত্ত্বিক পদ্ধতি। এর দ্বারা মুসলমানদের শিক্ষিত সমাজকে ধর্মচ্যুত করার জন্য তাত্ত্বিক অপকৌশল প্রয়োগ করা হয় । এখানেই ইমাম ও খতীবদের বিশেষ একটি কর্তব্য রয়েছে। আমাদের উচিত তূলনামূলক ধর্মতত্ত্ব চর্চা করা। খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখা। কাদিয়ানী ধর্ম সম্পর্কে জানা। সেজন্যে তাদের মূল বইগুলো যথা, ‘বারাহীনে আহমাদিয়্যাহ’, ‘রূহানী খাযায়েন’, ‘সিররুল খিলাফাহ’, “কিশতিয়ে নূহ’, ‘ইসলামী উমূল কা ফালাসাফাহ’ ইত্যাদি বইগুলো পড়াশুনা করা। বাহাঈ ধর্ম সম্পর্কে জানা। তাদের মূল গ্রন্থ আল কিতাবুল আকাদাস’, ‘কিতাবে ঈকান’ ইত্যাদি পড়াশুনা করা। তবেই আমাদের মুসল্লী সমাজকে ফিতনাগুলি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে সক্ষম হবো!

এছাড়াও সমাজের শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণীকে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার জন্য তারা আরও বেশ কিছু অপকৌশল অবলম্বন করে থাকে। যেমন, ইউরোপ বা পশ্চিমের দেশগুলিতে মাইগ্রেট করার লোভ দেখানো; পশ্চিমা নারীদের জীবনসঙ্গীনী করার প্রলোভন দেখানো; ব্যবসার পূজির যোগান দেওয়া; উচ্চ বেতনে চাকুরির সুবিধা দেওয়া ইত্যাদি এগুলোর প্রত্যেকটিরই বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। আমরা ইমাম ও খতীকাণ মুসল্লী সমাজের সামনে ফিতনায়ে ইরতিদাদের এই রূপগুলো উন্মোচন করে দিতে পারি, তাহলে সেটা অনেক বড়ো খেদমত হবে ইনশাআল্লাহ! ৩. আহলে কুরআন ফিতনা : আমাদের সমাজে এটি একটি নতুন ফিতনা প্রবল আকার ধারণ করেছে। এ সম্পর্কেও আমাদের ভালোমত জানাশুনা থাকা উচিত। বাংলাদেশ আইম্মাহ পরিষদের উদ্যোগে এ ফিতনা সম্পর্কে ইমামগণকে মৌলিক ধারণা দেবার জন্য কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে ইনশাআল্লাহ।

তৃতীয়ত:, জরুরিয়াতে দ্বীন’ বা দ্বীনের জরুরী ইলম অর্জনের জন্য মসজিদ কেন্দ্রিক কার্যকরী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা । একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আমাদের মুসলিম সমাজের মধ্য হতে মাদারিসে দ্বীনিয়াহ থেকে সরাসরি ভাবে দ্বীনি ইলম অর্জন করছে মাত্র ২শতাংশ মানুষ। বাকি ১৮শতাংশ মানুষই দ্বীনি ইলম হতে বঞ্চিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই ৯৮শতাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে মসজিদে এসেই থাকে। এক্ষেত্রে যদি আমরা মসজিদ কেন্দ্রিক জরুরিয়্যাতে দ্বীন’ সম্পর্কিত কোন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি, তাহলে দেখা যাবে এই বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনসাধারণকে আমরা দ্বীনের জরুরী ইলম প্রদান করতে সক্ষম হবো। আর এজন্য আমরা সাবাহী মক্তবের পাশাপাশি বর্তমানে বেশ ক’টি মান সম্মত কোর্স রয়েছে, সেগুলোর সহায়তা নিতে পারি। আর এ কোর্সগুলোর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, বিপুল গবেষণার পর এই ৯৮ শতাংশ মানুষের উপযোগী করে, তাদের সময়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে এই কোর্সগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। ফলে এগুলো যেমন মানসম্মত, তেমনি উপকারী এবং কার্যকরীও বটে। এ জাতীয় কোর্সগুলোর মধ্যে ‘দ্বীনিয়াত”, আফটার স্কুল মুনাজ্জাম মাকতাব’ উল্লেখযোগ্য। আমরা আমাদের মসজিদগুলোতে এ কোর্সগুলোর সহায়তা নিয়ে মসজিদ ভিত্তিক জরুরিয়্যাতে দ্বীন’ এর একটি কার্যকরী ‘তা’লীমি নেযাম’ বা ‘শিক্ষা ব্যবস্থা’ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।

চতুর্থতঃ, মসজিদকে বাস্তবিক অর্থেই সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। এর জন্য আমরা তিন ধাপে কাজ করতে পারি। প্রথম ধাপে আমরা শিশু-কিশোরদের উপযোগী এমন কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করবো, যার দ্বারা তারা মসজিদ এবং মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে এনগেজ বা সম্পৃত্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা তাদের জন্য মসজিদে একটি উন্নত মানের পাঠাগার তৈরী করতে পারি; সেই পাঠাগারের অধীনে শিশু-কিশোরদের অবসর সময়ে রাসূল সা. এর সীরাতের উপর কিংবা ইসলামী ইতিহাসের উপর বিতর্ক প্রতিযোগীতা, কুইজ প্রতিযোগীতা ইত্যাদির আয়োজন করতে পারি। সেই সাথে শিশু-কিশোররা যেন মসজিদে আসতে আগ্রহী হয়, সেলক্ষ্যে তাদের জন্য নানা পোগ্রাম ও পুরস্কার ঘোষণা করতে পারি। এ জাতীয় পরিকল্পনাগুলো সমাজের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।

দ্বিতীয় ধাপে তরুন ও যুবক সমাজকে মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, নেশা, ছিনতাই, রাহাজানী সহ সমাজের নানা অবক্ষয়, সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। যুবক ও তরুনদের মাঝে কার্যকরী বিভিন্ন পোগ্রাম গ্রহণ করা। আর এ সব বিষয়ে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে উদ্যোগী। হই, কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সমর্থ হই, তাহলে বহু সংস্থা রয়েছে, যারা আমাদের এ কাজগুলোকে আর্থিক সহায়তা বা স্পন্সর করার জন্য আগ্রহী হবে। পাশাপাশি বিয়ে জাতীয় সামাজিক কাজগুলোও যথাসম্ভব মসজিদ কেন্দ্রিক করার জন্য মুসল্লী সমাজকে উৎসাহিত করা। যদি ইমাম সাহেবগণ যুবক সমাজকে যথাযথ কাউন্সেলিং করার খেদমত আঞ্জাম দিতে পারেন, তাহলে এই খেদমতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ জাতীয় সমস্যাগুলোও ধীরে ধীরে কমে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর ইমাম সাহেবগণ ধর্মীয় প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি এ জাতীয় সামাজিক সমস্যাগুলোর যতোবেশি সমাধান করবেন, ততোবেশি যুবক সমাজ উলামায়ে কেরামের প্রতি কৃতজ্ঞ হবে এবং সেই সুবাদে মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে এনগেজ বা সম্পৃক্ত হবে ইনশাআল্লাহ।

তৃতীয় ধাপে আমরা সমাজের বয়োজৈষ্ঠ শ্রেণীকে মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে সম্পৃত্ত করার জন্য পরিকল্পনা। গ্রহণ করবো। এ ধাপে আমরা ‘খেদমতে খালক’ বা ‘আর্তমানবতার সেবা’ শিরোনামে বিভিন্ন সময় দুর্যোগ কবলিত অসহায় মানুষদের সহযোগীতা করা, এলাকার দুঃস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদেরকে সহায়তা করা, তাদের পুনর্বাসন করার জন্য স্বচ্ছল ও সামর্থ্যবান মুসল্লীগনকে নিয়ে যৌথ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করবো। আর সামগ্রিকভাবে এই কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়ার মাধ্যমে আমরা মসজিদকে সমাজের মানুষের নিকট আরোও বেশি অর্থবহ এবং উপকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো এবং এর মাধ্যমেই মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার একটি আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।

পঞ্চমতঃ, আমাদের অধীনস্থ মসজিদগুলোতে নিয়মিত কোন সাহেবে নেসবত বুজুর্গ ব্যক্তির মাধ্যমে মুসল্লীদের জন্য।

ইসলাহী মজলিশের ব্যবস্থা করা। আমরা আমাদের আকাবিরগণের রূহানী ফুযাত জনসাধারণের মাঝে যতোবেশি ছড়িয়ে দিতে পারবো, ততোবেশিই মসজিদ কেন্দ্রিক একটি দ্বীনি সমাজ গড়ার এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সহজ হয়ে উঠবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2024 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS