প্রযুক্তি ব্যবসার চরম নাটকীয়তার জন্ম দিয়ে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার কিনে নিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন ‘খ্যাপাটে’ মাস্ক। ইতিমধ্যে ছাঁটাই করেছেন প্রায় অর্ধেক কর্মী। নতুন কিছু চালু করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন এখন। সব মিলিয়ে টুইটারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
ইলন মাস্ক চলতি বছরের ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনকে জানান, টুইটারের ৯ দশমিক ২ শতাংশ শেয়ার তিনি কিনে নিয়েছেন। মাস্কের হাতেই টুইটারের সবচেয়ে বেশি শেয়ার। প্রথমে টুইটারের পরিচালনা পর্ষদের কেউ কেউ ব্যতিক্রম কিছু ভাবলেও ইলন মাস্ককে পর্ষদে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মাস্কও তা গ্রহণ করেন। তারপরই তিনি টের পেলেন, পর্ষদে যোগ দিলে ১৫ শতাংশের বেশি মালিকানা নিতে পারবেন না তিনি। ফলে পরক্ষণেই তিনি বোর্ডে যেতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ, ইলন মাস্ক মনে মনে ভিন্ন কিছুই ভাবছিলেন।
পরে ১৪ এপ্রিল ইলন মাস্ক টুইটারের প্রতিটি শেয়ার ৫৪ দশমিক ২০ ডলারে সব শেয়ার কিনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। তাতে টুইটারের বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। প্রভাবশালী এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হওয়ার পর এই কেনাবেচা ঠেকানোর চেষ্টা করে পর্ষদ। এমনকি ইলন মাস্ক যাতে কোম্পানিটি কিনতে না পারেন, সে জন্য একটি বিধিও তৈরি করা হয়।
‘দুজনে দুজনার’
টুইটারে ইলন মাস্কের প্রোফাইলে প্রবেশ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে তিনি টুইটার অ্যাকাউন্টটি খোলেন। প্রথম টুইট করেন ২০১০ সালের ৫ জুন। প্রথম টুইটের দেড় বছর পর তিনি দ্বিতীয় টুইটে লেখেন, ‘তিনি আয়ারল্যান্ডে ছুটি কাটাতে যাবেন’। পরের ১৩ বছরে টুইটারের সঙ্গে তাঁর সখ্য ও ফলোয়ারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
বর্তমানে টুইটারে ইলন মাস্কের ফলোয়াড়ের সংখ্যা সাড়ে ১৫ কোটি! নিজের টুইটার ব্যবহার সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন। নিজের অনুসারীদের তিনি এই অ্যাকাউন্ট দিয়ে প্রায়ই নাচান, উত্তেজিত করেন এবং কখনো কখনো মিম শেয়ার করেন। ২০১৭ সালে মাস্ক টুইটার নিয়ে তাঁর প্রথম টুইটটি করেন। সেটি ছিল—আই লাভ টুইটার। প্রতি–উত্তরে টুইটারের সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি টুইট করেন—আমিও। সেই সময় একজন ব্যবহারকারী লেখেন—তাহলে তুমি সেটা কিনতে পারো। তখন মাস্ক জানতে চান, এটার দাম কত? তখনো তার মনের কোণে টুইটার কেনার বিন্দুমাত্র চিন্তাও ছিল না বলেই মনে হয়। কারণ, সে সময় টুইটারের বাজার মূলধন ছিল ২ হাজার কোটি ডলার। আর মাস্কের সম্পদ মূল্য ২ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
ধন্য আশা
মাস্ক গত মে মাসে টুইটারের ব্যবসা বাড়ানোর কিছু পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। তাঁর হিসাবে, পেইড গ্রাহক থেকে ২০২৮ সাল নাগাদ টুইটারের আয় দাঁড়াবে ১০ বিলিয়ন ডলার, যা টুইটারের বর্তমান আয় ৫ বিলিয়ন ডলারের দ্বিগুণ! টুইটার নিয়ে ইলন মাস্কের সেই পরিকল্পনার মধ্যে আরও ছিল:
ব্যবহারকারী বৃদ্ধি: ২০২১ সালে টুইটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২১ কোটি ৭০ লাখ। ২০২৫ সালের মধ্যে টুইটারের ব্যবহারকারী ৬০ কোটি এবং ২০২৮ সালের মধ্যে সেটি ৯৩ কোটি ১০ লাখে পৌঁছাবে বলে মাস্কের বিশ্বাস।
টুইটার ব্লু টিক গ্রাহক: টুইটার ‘ব্লু’ টিক সেবা চালু করে গত বছর। যার জন্য মাসে ২ দশমিক ৯৯ ডলার দিয়ে গ্রাহকেরা কিছু বাড়তি সুবিধা পান। মাস্ক আশা করছেন, ২০২৮ সালে এ ধরনের গ্রাহকের সংখ্যা ১৫ কোটি ৯০ লাখে উন্নীত হবে। তখন এ খাত থেকে ১ হাজার কোটি ডলার আয় আসবে।
এক্স গ্রাহক: নতুন একটা পেইড সার্ভিসের পরিকল্পনার কথাও জানান মাস্ক। তাঁর হিসাবে, নতুন এ সেবার গ্রাহক আগামী বছরই ৯০ লাখ হবে। মাস্কের দাবি, ২০২৮ সালে এ সংখ্যা ১০ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এক টুইট বার্তায় তিনি লেখেন—সরকারি ও বাণিজ্যিক ব্যবহারকারীদের টুইটার ব্যবহারের জন্য একটা ‘ছোট্ট’ ফি দিতে হবে।
ডেটা লাইসেন্সিং: বর্তমানে টুইটারের আয়ের একটি বড় উৎস ডেটা লাইসেন্সিং। এই সেবার মাধ্যমে গ্রাহক নির্দিষ্ট ঘরানার টুইট বিশ্লেষণ করার জন্য ডেটা সুবিধা পান। বর্তমানে খাতটি থেকে টুইটারের আয় প্রায় দেড় কোটি ডলার। মাস্ক এটিকে সম্প্রসারণ করে ২০২৮ সালে ১৩০ কোটি ডলারে উন্নীত করতে চান।
মাস্কের ভাবনায় গলদ
টুইটার অধিগ্রহণের পর মাস্কের হিসাব–নিকাশ কিছুই মিলছে না। যেমন নতুন সেবা চালু ও টুইটারের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য লোকবল বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। নিউইয়র্ক টাইমস খবর দিয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে টুইটারের কর্মী সংখ্যা ১১ হাজার ৭২ জনে উন্নত করবেন মাস্ক। তবে মালিকানা হাতে নিয়েই মাস্ক ব্যাপকভাবে লোকবল ছাঁটাই করতে শুরু করেছেন। ৭ হাজার ৫০০ কর্মীর এই কোম্পানি থেকে ইতিমধ্যে তাদের প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে অফিস সহকারী পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০০ কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। তাদের কারও কারও চাকরি গেছে জুমে সভা করার সময় আবার কেউ সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পেরেছেন, ‘ইয়োর সার্ভিস ইজ নো লঙ্গার রিকয়ার্ড’।
টু বি অর নট টু বি
জানা গেছে, ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ব্যাংকঋণের বিপরীতে আগামী বছর থেকে টুইটারকে ১০২ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতাদের ফিরিয়ে আনা, প্রতিষ্ঠানজুড়ে অস্থিরতা ও আস্থাহীনতা, দলে দলে ব্যবহারকারীদের অন্য প্ল্যাটফর্মে চলে যাওয়া রোধ করা, কোনোটাই এখন সহজ নয়। কাজেই সামনের দিনে টুইটার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ৯ নভেম্বর কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে এ আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দেননি স্বয়ং মাস্কও।
                                
									Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply