সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন

জাতীয় সাহিত্য অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী,

আমি কি ভুলিতে পারি।

বাঙালি জাতির বিজয়ের অনুপ্রেরণা জন্মেছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। মাতৃভাষা বাঙলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য আত্মাহুতি দিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এ দেশের দামাল ছেলেরা। সেই দিবসটিই আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তথ্য মতে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৮৮ টি দেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালন করছে। যাহা বাঙালি জাতির জন্য অর্জিত একটি গর্বিত ইতিহাস। ১৯৫২ সনে শহীদ দিবসকে ঘিরেই ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সঞ্চার ঘটে বাঙালি জাতির হৃদয় গভীরে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করেন। আমাদের জাতীয়তাবাদ ও বাঙালিয়ানার গর্ব ইতিহাস, ঐতিহ্যের জোয়ার ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। মহান একুশের চেতনা থেকেই বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা, ১৯৬৯ এর ৪ঠা জানুয়ারী সর্বদলীয়  ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর ঐতিহাসিক ১১ দফা, ৬৯ এর গণ—অভ্যুথান। পরবর্তীতে ১৯৭১ সনে ৯ মার্চ মওলনা ভাসানীর ১৪ দফা। বাঙালি জাতির স্বপ্নপুরণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক ১৯৭১—এর মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে  মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে দেশের জনগণ । যুদ্ধক্ষেত্রে ছাত্র, কৃষক, আবাল, বৃদ্ধ, মেহনতি শ্রমিক জনতার পাশাপাশি  দেশপ্রেমে উদ্ভোদ্ব হয়ে নারীরাও অংশ গ্রহণ করেছিল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ি যুদ্ধ।  অত:পর ৩০ লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগ, প্রায় দুই লক্ষাধিক মা—বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হলো স্বাধীনতা। ফলশ্রম্নতিতে সুষ্পষ্টভাবে প্রমানিত যে, মুক্তিযুদ্ধের সুতিকাগার হলো ভাষা আন্দোলন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্বীকৃতি বাঙালি ও বাঙলা ভাষাভাষীদের  দায়িত্ব আরো বেড়ে গেছে। বাঙলা ভাষা ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। বাঙলা সাহিত্য কে বিশ্বব্যাপী প্রচার—প্রসারে গবেষণামূলক ভাবে আরো কাজ করতে হবে। মাতৃভাষা বাঙলার উন্নয়নে সাহিত্যসেবী বা সাহিত্যকর্মীদের গবেষণা করার মনোরম পরিবেশ সম্মত গবেষণা ক্ষেত্র তৈরি করা আব্যশক। সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে যেমন সামাজিক রীতিনীতির প্রকাশ ঘটে, তেমনি মানুষের ভাব—আবেগও প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হলো সাহিত্য। সাহিত্য আমাদের অন্যায়, অবিচার, বেবিচার রোধের কল্যাণে কাজ করে।  সাহিত্য মনুষ্যত্বের সার্বিক বিকাশ সাধন করে এবং সত্যকে উৎঘাটন করে । সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে সভ্যতার বাহক হলো সাহিত্য।  অত্যন্ত দু:খ ও পরিতাপের বিষয় হলো যে, ভাষা আন্দোলন এবং মাতৃভাষা অর্জনের ৭১ বছর অতিবাহিত হলেও বাঙলা সাহিত্যের উন্নয়ন অগ্রগতির লক্ষে এই দেশে এখনো সাহিত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলা একাডেমি বা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রর কাজটা কি? এ বিষয়ে দেশের জনগণ আজও পর্যন্ত জানে না। বাঙলা একাডেমি কতৃর্ক অমর একুশে একটি বইমেলা  উদযাপন, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র বছরে একবার কিছু বই ক্রয় করা ছাড়া বাংলা সাহিত্যের কল্যাণে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কোন কাজই দেশের  জনগণের চোখে পড়ে না।  বাংলা সাহিত্যের সাথে সংযুক্ত বাঙলা একাডেমি এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, প্রতিষ্ঠান দুটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অন্তভূর্ক্ত হলেও বাঙলা সাহিত্যকে সমুজ্জ্বল করে তুলতে বা বাঙলা সাহিত্যের উন্নয়ন অগ্রগতি বা নতুন লেখক সৃষ্টি বা লেখকদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে সরকারের সুনিদিষ্ট কোন নির্দেশনা বা বিধি—বিধান না থাকায় বাঙলা সাহিত্যের অগ্রগতিতে তাদের কোন কর্মকান্ড চোখে পড়ে না। সময় এসেছে বাঙলা সাহিত্য ভিত্তিক একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার। ইদানিং পত্র—পত্রিকায় প্রকাশিত জাতীয় সাহিত্য অধিদপ্তর বাস্তবায়ন পরিষদ কতৃর্ক মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ দপ্তরে দাখিলকৃত স্মারকলিপিতে উল্লেখিত “জাতীয় সাহিত্য অধিদপ্তর” প্রতিষ্ঠার দাবীটি যৌক্তিক ও সময়োপোযোগী। 

ডাটাবেজ তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কতৃর্ক নির্ধারিত ফরমে সব শ্রেণীর শিল্পীদের  তথ্য চাওয়া হয়ে থাকে। দুভার্গ্যজনক হলেও অপ্রীয় সত্য হলো যে, বাঙলা একাডেমি বা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে লেখকদের তথ্য সম্ভলিত নির্ধারিত কোন ফরম আজও পাওয়া যায়নি । অর্থাৎ অভিবাবকহীন কবি সাহিত্যকদের ডাটাবেজ তৈরিতে সরকারের কোন উদ্যোগ নাই। জেলা শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক সরবরাহকৃত ফরমগুলিতে নাটক, সংগীত, নৃত্য বিভাগ ও  উপ+বিভাগ ইত্যাদি উল্লেখ থাকলে আরও কয়েকটি বিভাগ হাতে লিখে ফরম জমা দেওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে । অথচ কবি— সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠন গুলির তথ্যদানের কোন পরামর্শ নাই। এখানে প্রশ্ন জাগে যে, রক্তের বিনিময় অর্জিত মাতৃভাষা বাঙলার সাহিত্যকর্মীরা কোন মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোন অধিদপ্তরের অধীনে।  সাহিত্য কর্মীদের ডাটাবেজ/তথ্যদি কি সরকারের সংরক্ষণের প্রয়োজন নাই। কবি— সাহিত্যিকদের পরিচর্যার বিষয়ে কোন সরকারেরই উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি আজও । দেশ ব্যাপী  সাহিত্য সংগঠনগুলির তথ্য সরকারের কাছে নাই। সংগঠন গুলির রেজিষ্ট্রেশন বিষয়েও সরকারের কোন বিধি—বিধান নাই। সাহিত্য অনুষ্ঠান গুলিতে সরকারি কোন অনুদান না থাকায়, সমাাজের মুষ্টিময় বিত্তশালী এবং সাহিত্যকর্মীদের নিজ উদ্যোগে অর্থ সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে সাহিত্য সংগঠন গুলি কোন রকমে গরিবীহালতে চলছে।  জাতির বিবেক কবি সাহিত্যিকগণ এতটা  অবহেলিত কেন? মহান মুক্তিযোদ্ধের সময় গান নাটক ও কবিতা আর লেখকদের খুরধার লেখনি জনমনে সাহস ও শক্তি সঞ্চার করেছে। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধে লেখকদের ভূমিকা ছিল অনন্য। পাক বাহিনীর সামরিক জান্তাগণ যখন বুঝতে পেরেছিল যে, তারা আর টিকতে পারবে না । সে কারণেই তারা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর এ দেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে বাঙালি জাতিকে বিবেকহীন জাতিতে পরিণত করার হীন উদ্দেশ্যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছিল।  ভাগ্যোর কি নির্মম পরিহাস মুক্তিযুদ্ধের সুতিকাগার ভাষা আন্দোলন।  সেই মাতৃভাষা বাঙলা সাহিত্যের সাহিত্যকর্মী কবি—সাহিত্যকগনই আজও সরকারের তালিকার বাইরে রয়ে গেলো।

সংস্কৃতি বিষয়ক  মন্ত্রণালয়ধীন- বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর,  গণগ্রন্থাগার,  আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার,  বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস,  বাংলা একাডেমি,  বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি,  বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর,  নজরুল ইন্সটিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র,  বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প  ফাউন্ডেশন ,  বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, রাঙামাটি,  ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট বান্দরবান,  কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র,  ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট খাগড়াছড়ি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, রাজশাহী ,  মণিপুরী ললিতকলা একাডেমি মৌলভীবাজার অধিদপ্তর সমূহ রয়েছে।  অত্যন্ত দু:খ ও পরিতাপের বিষয় হলো যে, রক্ত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা, বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন ও মেধা  বিকাশের পৃথক ক্ষেত্রটি আজও অবধি প্রতিষ্ঠা হয়নি বাংলাদেশে।

 রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাঙলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত  হলেও  দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত সাহিত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় গড়ে উঠেনি। আমরা জানি, নতুনভাবে একটি  মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময়ের ব্যপার।   তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাহিত্যকে কেন্দ্র করে নতুন একটি  পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রায় দু:সাধ্য। বিদ্যমান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাথে সাহিত্যকে যুক্ত করে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নামকরণ  করা হলে  সরকারকে আর  বেগ পেতে হবে না। তাই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে এর অধীনে “জাতীয় সাহিত্য অধিদপ্তর” প্রতিষ্ঠা করার দাবীটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। সর্বোপরি সাহিত্যের কল্যাণে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নামের সাথে ‘সাহিত্য’কে সংযোজন করে “সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়” হিসেবে নামকরণের মাধ্যমে, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর অধীনে পৃথক “জাতীয় সাহিত্য অধিদপ্তর” প্রতিষ্ঠা করাই হবে সরকারের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS