মোঃ আব্দুল্লাহ হক, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই অব্যবস্থাপনার বেড়াজালে জর্জরিত। লোকবল সংকট, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে হাসপাতালটির সার্বিক অবস্থা এখন চরম সংকটময়। ১৩ লাখ জনসংখ্যার এই জেলায় এটি একমাত্র সরকারি হাসপাতাল হলেও, সেবার মানে তীব্র অবনতি ঘটেছে। ফলে চিকিৎসা নিতে এসে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি ২০০৪ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও এখনো কার্যত ৫০ শয্যার জনবল দিয়েই হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অথচ দৈনিক বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় দেড় হাজার রোগী, আর ওয়ার্ডে ভর্তি থাকেন গড়ে ৩০০-৩২০ জন। এই বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে হাসপাতালটিতে বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ২৬ জন চিকিৎসক ও ৬৫ জন নার্স।
তথ্যমতে, নতুন ও পুরনো ভবন মিলিয়ে পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় কর্মরত মাত্র ৪ জন কর্মচারী। এতে ওয়ার্ড, ওটিসহ পুরো হাসপাতালজুড়ে বিরাজ করছে নোংরা পরিবেশ। অধিকাংশ টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী। দুর্গন্ধ ও মশার উপদ্রবে রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
জরুরি বিভাগেও চিকিৎসা পেতে ঘুষের অভিযোগ উঠেছে। অনেক রোগী ও স্বজনরা জানিয়েছেন, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে টাকা আদায় করা হচ্ছে। ডাক্তারদের সময়মতো পাওয়া যায় না, প্রয়োজনীয় ওষুধেরও সংকট রয়েছে।
সদর হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট রয়েছে শুধু খাতায়-কলমে। দরজায় তালা ঝুলছে দীর্ঘদিন ধরে। অপারেশন থিয়েটারও ছিল বন্ধ। সম্প্রতি পাশের উপজেলা জীবননগর থেকে একজন অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক এসে অস্থায়ীভাবে সেবা দিচ্ছেন।
চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগে পদ শূন্য রয়েছে। চক্ষু, মেডিসিন, নাক-কান-গলা, রেডিওলজি ও ডেন্টাল বিভাগে চিকিৎসকের পদ খালি। নার্সের তুলনায় রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় চিকিৎসা সেবা কার্যত ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার রেহেনা পারভীন বলেন, “মেহেরপুর জেলা হাসপাতালে ১৬৫ জন নার্স থাকলেও আমাদের এখানে আছে মাত্র ৬৫ জন। রোগীর চাপ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। আমরা হিমশিম খাচ্ছি।”
অপর নার্সিং সুপারভাইজার মমতাজ বেগম জানান, “পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে ২২টি শয্যা থাকলেও রোগী থাকে ৮০ জনের বেশি। কিন্তু খাবারের বরাদ্দ মাত্র ২২ জনের জন্য। পরিবেশের অবনতিতেও রোগী ও স্বজনদের অসচেতনতা দায়ী। তারা নিয়মিত ডাস্টবিন ব্যবহার করেন না।”
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের প্রধান সহকারী ও হিসাবরক্ষক মো. আব্দুস ছবুর বলেন, “২৫০ শয্যায় উন্নীত করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশেপাশের সব জেলা সদর হাসপাতালেই ২৫০ শয্যা থাকলেও এখানকার অবস্থা ভিন্ন।”
তত্ত্বাবধায়ক বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, “চিকিৎসক সংকটের কারণে কিছুটা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ, সরঞ্জাম ও অ্যান্টিভেনম রয়েছে। দালাল চক্রের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।”
চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আওলিয়ার রহমান জানান, “৫০ শয্যার জনবল দিয়ে পুরো হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে। আমরা ১০০ শয্যার জনবল চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। শিগগিরই পদ সৃষ্টির মাধ্যমে সংকট নিরসন হবে বলে আশা করছি।”
এদিকে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষ দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেছেন।
ডিঙ্গেদহ থেকে আসা রেজাউল করিম বলেন, “হাসপাতালের পরিবেশ খুবই খারাপ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি মারাত্মক। রাত হলে মশার উপদ্রব ভয়াবহ। ওষুধ পেতে হয় বাইরের ফার্মেসি থেকে।”
সরোজগঞ্জ থেকে আসা টিটু আহমেদ বলেন, “জরুরি বিভাগেও লাইন দীর্ঘ। গুরুতর রোগীদের বাইরে রেফার্ড করে দেওয়া হয়। তাহলে এই হাসপাতালের দরকারটা কী?”
ভালাইপুর থেকে আসা সাহার বানু বলেন, “চিকিৎসা নিতে এসেছিলাম। লম্বা লাইনের পর ডাক্তার দেখাতে পেরেছি। কিন্তু প্রেসক্রিপশনে দেওয়া ওষুধের একটিও হাসপাতালে পাইনি। বাইরে থেকে কিনেছি সব।”
চুয়াডাঙ্গা জেলার বাসিন্দাদের দাবি, এতদিন রাজনৈতিক প্রভাবিত প্রশাসন হাসপাতালের সংকটকে উপেক্ষা করেছে। তারা আশা করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের এই নাজুক অবস্থা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন আর চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার যে অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ, পর্যাপ্ত জনবল, আধুনিক অবকাঠামো ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ। জনস্বার্থে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের উন্নয়নে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ সময়ের দাবি।
Leave a Reply