নিজস্ব প্রতিবেদকঃ তামাক ব্যবহারের মাত্রা এবং এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের শিকার হওয়া জনসংখ্যার অনুপাতের বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর বা বেশি) তামাক ব্যবহার করে এবং প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান না করেও বিভিন্ন পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৩-১৫ বছর) মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ তামাক ব্যবহার করে। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে ।
এটি অবশ্যই দুর্ভাবনার বিষয়। তামাকের করাল গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে তাই বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি আরও শক্তিশালীকরণের জোর দাবি উঠছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই বাস্তবতার নিরিখেই ২০১৬ সালে “সাউথ এশিয়া স্পিকারদের শীর্ষ সম্মেলন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন’ বিষয়ক অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তৃতায় নির্দেশনা দিয়েছেন যে, তিনি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চান। ঐ নির্দেশনায় তিনি সুস্পষ্টভাবে তামাকের ওপর কর কাঠামো ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি তামাক বিষয়ক আইনগুলোকে আন্তর্জাতিক কনভেনশন অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার পথনকশা দিয়েছেন।
নাগরিক সমাজ এবং তামাক-বিরোধী সংগঠনগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণের জন্য মোটা লাগে মোট ছয়টি প্রস্তাব হাজির করেছে। এগুলো হলো: (০১) ধূমপানের নির্ধারিত এলাকা বাতিল: (০২) বিয়েহলে তামাক পণ্যের প্রদর্শনী বন্ধ; (০৩) তামাক কোম্পানির সিএসআর বন্ধ, (০৪) তামাক পণ্যের প্যাকেটের গায়ে সচিত্র সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধি, (০৫) সিঙ্গেল স্ট্রিক সিগারেট/বিড়ি বিক্রি বন্ধ, এবং (০৬) ই-সিগারেট নিষিদ্ধ।
সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত দেশ গড়ার নির্দেশনা এবং তামাক-বিরোধীদের কাছ থেকে আসা দাবিগুলোর প্রতি যথাযথ সংবেদনশীলতা দেখিয়ে “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) সংশোধনের জন্য একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে।
১৬ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত ১৫ হাজারেরও বেশি নাগরিক ও সংগঠন এই সংশোধনীর প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।
সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রাধিকারের সাথে মিল রেখে আমরা আমাদের আইনগুলো ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের সাথে সামগ্রস্যপূর্ণ করে আবার সংশোধন করবো।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাউথ এশিয়ান স্পিকার সামিট ঢাকা, জানুয়ারি, ২০১৬”
এদের মধ্যে ১৫৫ জন মাননীয় সংসদ সদস্য ছাড়াও রয়েছেন বিএমএ এবং সন্ধানীসহ ২০টির বেশি চিকিৎসক সংগঠন, শতাধিক স্বনামধন্য চিকিৎসক এবং নার্স। আরও আছেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। কয়েকটি বিশ্ববদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যও সমর্থন জানিয়েছেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকদের পাশাপাশি ল-চেম্বার এবং বিজ্ঞ আইনজীবীদের মধ্যেও অনেকে সমর্থন জানিয়েছেন এই সংশোধিত খসড়াটির প্রস্তাবে।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি সংগঠন, রেস্টুরেন্ট ওনার্স এসোসিয়েশন, দিন মঞ্জুর, এমন কি বিড়ি শ্রমিকরাও সমর্থন দিয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন ধর্মীয় নেতা এবং অনেক সেলিব্রিটিও। সাংবাদিকদের সংগঠনের পাশাপাশি এককভাবে অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিকও ইতোমধ্যে সমর্থন আপন করেছেন। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে এমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর কাছ থেকেও ব্যাপকভিত্তিক সমর্থন পাওয়া গেছে। মোট কথা, সংশোধিত খসড়ার প্রস্তাবগুলোতে বৃহত্তর জনদাবিগুলো প্রতিফলিত করা গেছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে সমর্থন করছেন সকল স্তরের অংশীজনেরাই।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের অধিকতর সংশোধনীটি এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে খসড়াটির প্রতি ব্যাপক জন-সমর্থন জানানো হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ আইন হিসেবে এটিকে কার্যকর করতে এখনও অনেকগুলো প্রশাসনিক ও সংসদীয় ধাপ অতিক্রম করতে হবে। এ জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। জনস্বার্থের বিষয়ে সদা-সংবেদনশীল আইনপ্রণেতাদেরও নিজ নিজ জায়গা (সংসদের ভেতরে ও বাইরে) থেকে এগিয়ে আসতে হবে যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই আইনটি মহান জাতীয় সংসদে পাশ করিয়ে আনা সম্ভব হয়। একই সঙ্গে তামাক-বিরোধী নাগরিক সংগঠন এবং গবেষকদের সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে যাতে করে নীতি-নির্ধারকবৃন্দ সংশোধনীর পক্ষের যুক্তিগুলো যথাযথভাবে অনুধাবন করে গণমুখী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন।
প্রস্তাবিত সংশোধনী মহান জাতীয় সংসদে গৃহীত হলে দেশের তামাক ব্যবহারের মাত্রা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ফলে স্বভাবতই স্বার্থান্বেষি মহল এক্ষেত্রে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চাইবে। এক্ষেত্রে সংশোধনীটি সম্পর্কে অপপ্রচারের আশঙ্কা রয়েছে। সম্মানিত নীতি-নির্ধারকসহ সকল অংশীজনকে বারবার তথ্য-প্রমাণসহ স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, প্রস্তাবিত খসড়ায় জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনটি এমনভাবে শক্তিশালী করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশের দিকে যথাযথ গতিতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। অর্থাৎ, কার্যকর আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাক পণ্যের ব্যবহার কাঙ্খিত হারে কমিয়ে আনাই এই প্রস্তাবনার মূল লক্ষ্য।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply