শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ০২:৫৩ পূর্বাহ্ন

ক্রোয়েশিয়াকে উড়িয়ে স্বপ্নের ফাইনালে মেসির আর্জেন্টিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গেছে আর্জেন্টিনা। পেনাল্টি থেকে গোল করেছেন মেসি, জোড়া গোল জুলিয়ান আলভারেজের। চার রাত পর লুসাইলেই হবে ফাইনাল, সেখানে দুই ‘এলএম ১০’ লুকা মডরিচ এবং লিওনেল মেসির একজন থাকবেন, একজন নেবেন বিদায়।

বিদায় নেয়া মানুষটি লুকা মডরিচ। কারণ, ২০১৪’র পর আবারও বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা। গত বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে গ্রুপ পর্বে হারের প্রতিশোধ আকাশি-নীলরা নিয়েছে তাদের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে একই ব্যবধানে হারিয়ে। ১৮ ডিসেম্বরের ফাইনালে সামনে মরক্কো নয়তো ফ্রান্স।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৫-৩-২ ছকে খেলে জিতে সেমিফাইনালে আসার পর আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি ফিরে গেছেন পুরোনো ৪-৩-১-২ ছকে। দুই হলুদ কার্ড দেখা মার্কোস আকুনা খেলতে পারছেন না, তার জায়গায় নিকোলাস তেগলিয়াফিকো একাদশে ফিরেছেন। লিয়ান্দ্রো পারাদেস খেলেছেন লিসান্দ্রো মার্তিনেজের জায়গায়। ব্রাজিলের বিপক্ষে জেতা ম্যাচের শুরুর একাদশে কোনো পরিবর্তন আনেননি ক্রোয়েশিয়ার কোচ জলাতকো দালিচ।

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে একটা জুয়াই খেলেছেন স্কালোনি। প্রথাগত মাঝমাঠনির্ভর বিল্ড-আপ প্লে’র বদলে দ্রুতগতির কাউন্টারঅ্যাটাক-নির্ভর ফুটবল, যা সাধারণত লাতিন দেশগুলোর কৌশল নয়। জুলিয়ান আলভারেজকে একদম সামনে রেখেছেন স্কালোনি, মাঝে মেসি আর ব্যাকলাইন থেকে থ্রুটা দেবেন ম্যাকঅ্যালিস্টার- এই কৌশলের কাছেই প্রথমার্ধে বোকা বনে গেছে ক্রোয়েশিয়া। হাই-লাইন প্রেসিংয়ের কৌশলে আর্জেন্টিনার মাঝমাঠের খেলার জায়গাটা ছোট করে আনতে চেয়েছিলেন দালিচ, যে কৌশলে সফল হয়েছিলেন সৌদি আরবের কোচ হার্ভে রেনাঁ। কিন্তু সেদিন স্কালোনির দলে ছিলেন লাউতারো মার্তিনেজ আর এ ম্যাচে জুলিয়ান আলভারেজ। দুজনের বল-প্লেয়িং স্কিলটাই গড়ে দিয়েছে ব্যবধান।

মার্তিনেজ ছোট বেলা থেকেই প্রথাগত সেন্টার ফরোয়ার্ড। অন্যদিকে জুলিয়ান আলভারেজ বলটা পায়ে রাখতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য, ছোটবেলায় ভাই আর বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় এতটাই বল পায়ে রাখতে চাইতেন মনে হতো মাকড়শার মতো আটপায়ে বলের নিয়ন্ত্রণ রাখছেন! সেজন্যে নামই হয়ে যায় ‘লা আরানা’ বা মাকড়শা। রিভারপ্লেটে খেলার সময় তার ‘মাকড়শা’ নামটা এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, স্পাইডারম্যানের মুখোশ পড়েও তাকে উদযাপন করতে দেখা যায়। প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার দুই গোলের নায়ক এই মাকড়শামানবই। প্রথমটা যদিও লিওনেল মেসির, পেনাল্টি থেকে করা। সেই পেনাল্টিটা এসেছে আলভারেজকে করা ফাউলের কারণেই।

সূত্রপাত ইভান পেরিসিচের গোলের সুযোগ নষ্ট থেকে। ম্যাচের ৩১ মিনিটে দারুণ দলীয় আক্রমণ ক্রোয়েশিয়ার, বক্সের ভেতর বাম প্রান্ত থেকে চিপ করেন ইভান পেরিসিচ। বলটায় জোর একটু বেশি হয়ে যায়, আলতো করে বলটা গিয়ে পড়ে জালের উপর। গোলকিক থেকে খেলা শুরু, এনজো ফার্নান্দেজ মাঝমাঠে বলটা লুকা মদ্রিচের পা থেকে কেড়ে নিয়ে পাস দেন আলভারেজকে। ছুটতে থাকা আলভারেজকে এসে বাধা দেন লিভাকোভিচ। ফলে পেনাল্টি, স্পটকিকে বাম পায়ের জোরাল শটে টপ কর্নারে বল পাঠান মেসি। লিভাকোভিচ ঝাঁপিয়েছিলেন ঠিক দিকেই, কিন্তু বলের গতি ছিল প্রচণ্ড।

এই গোলেই বিশ্বকাপের গোলসংখ্যা ১১ হয়ে গেল মেসির, ছুঁয়ে ফেললেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে। বিশ্বকাপে গোলসংখ্যায় বাতিগোল আর মেসি আপাতত সমান, মেসির সুযোগ আছে ফাইনালে গোল করে সবার উপরে উঠে যাবার। মিনিট পাঁচেক পর আবার গোল আর্জেন্টিনার, এবারও কাউন্টার অ্যাটাকে। ক্রোয়েশিয়ার আক্রমণ থেকে কর্নার, সেই কর্নার থেকেই আর্জেন্টিনার কাউন্টার অ্যাটাকের শুরু। বল ক্লিয়ারেন্সে মেসি দাবি করেছিলেন মাঝমাঠে তাকে ফাউল করা হয়েছে, রেফারি বললেন খেলা চালিয়ে যেতে। বল পেলেন আলভারেজ, তারপর একটা দৌড়। মাঝমাঠ থেকে আলভারেজের দৌড়ে পেছনে ছিটকে পড়লেন ক্রোয়েশিয়ার তিনজন, শেষ বাধা দিতে আসা বার্না সোসাকে ডিঙালেন অবিশ্বাস্য দক্ষতায়। তারপর হাওয়ায় ভেসে বুটের ডগা দিয়ে যেভাবে বলটা জালে পাঠালেন, ঐ মুহূর্তটাকে মনে হতে পারে কোনো ব্যালে নৃত্যশিল্পীর অপরূপ শৈলি!

প্রথমার্ধ শেষে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে। শুরুতে খানিকটা আড়ষ্ট হলেও মাঝের ৭ মিনিটের ঝড়ে দুটো গোল আদায় করে তখন স্বস্তিতে আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে চমকে যাওয়া ক্রোয়েশিয়া খেলা যত গড়িয়েছে ততই খেই হারিয়েছে। সেই সুযোগে ৬৮ মিনিটে আরো একটা গোল আর্জেন্টিনার। এবারে ডানপ্রান্তের সাইডলাইন ঘেঁষে উপরে উঠেছেন মেসি, সঙ্গে জোঁকের মতো লেগে আছেন জসকো জিভার্ডিওল। মেসিও মার্কারকে সঙ্গে রেখেই ছুটলেন, ডি বক্সের ভেতরে টার্নে বোকা বানালেন, পাস দেবার জায়গা বের করলেন। ততক্ষণে ডি বক্সের সামনে পৌঁছে গেছেন আলভারেজ। মেসির কাছ থেকে আসা পাসটায় অনায়াসেই বল ঢুকিয়ে দিলেন পোস্টে। যে লিভাকোভিচকে ব্রাজিলের বিপক্ষে মনে হচ্ছিল অপ্রতিরোধ্য, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তাকেই দেখালো অতি সাধারণ!

৭৪ মিনিটে একাদশে দুটো বদল আনলেন স্কালোনি। জুলিয়ান আলভারেজকে তুলে পাউলো দিবালা আর রদরিগো ডি পলকে তুলে এজেকিয়েল প্যালাসিওসকে নামালেন। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট- ফাইনালের আগে তুরুপের তাস আলভারেজকে যতটা সম্ভব বিশ্রাম দেয়া। অন্যদিকে দিবালাকেও একটু তৈরি করে নেয়া। কারণ, খেলা ততক্ষণে পুরোই আর্জেন্টিনার নিয়ন্ত্রণে। শেষ দিকে কিছু বিচ্ছিন্ন চেষ্টা ছিল ক্রোয়েশিয়ার, আর্জেন্টিনাও ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ৩-০ থেকে বদলায়নি স্কোরলাইন। হয়ত এটাই লেখা ছিল নিয়তির খাতায়, কারণ, ২০১৮ বিশ্বকাপে এই ব্যবধানেই যে ক্রোয়েশিয়া হারিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে।

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে গোল করে ও করিয়ে বেশ কিছু রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন মেসি। সেমিফাইনালটা ছিল বিশ্বকাপে মেসির ২৫তম ম্যাচ, জার্মানির লোথার ম্যাথাউসের সঙ্গে সমান সংখ্যাক ম্যাচ খেলে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড এখন যুগ্মভাবে মেসি ও ম্যাথাউসের। ১৮ ডিসেম্বর ফাইনালে খেলতে নামলে মেসিই হয়ে যাবেন বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ফুটবলার।

পাঁচটা বিশ্বকাপে গোলের অ্যাসিস্ট করা একমাত্র ফুটবলারও এখন মেসি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলেন পেলে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও ডেভিড বেকহাম, প্রত্যেকে অ্যাসিস্ট করেছেন ৩টি বিশ্বকাপে। বাতিস্তুতার রেকর্ডে মেসি ভাগ বসিয়েছেন গোল করে, আর অ্যাসিস্ট করে ভাগ বসিয়েছেন পেলের রেকর্ডে। নকআউট পর্বে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট (৬টি) এখন পেলে এবং মেসির।

সেমিফাইনালে ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও পেয়েছেন মেসি, এই নিয়ে বিশ্বকাপে মোট ১০ বার ম্যাচসেরার পুরষ্কার পেলেন মেসি। পুরষ্কারটা নিতে গিয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে মেসি বলেন, ‘প্রচণ্ড স্নায়ুচাপের ভেতরে থেকে এই ম্যাচটা শুরু করেছিলাম আমরা। আমরা জানতাম এমনটাই হবে, সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা জানতাম ওরা মাঝমাঠে বলের দখল অনেক রাখতে চাইবে, কারণ, ওরা এই জায়গায় ভালো আর ওদের অনেক ভালো খেলোয়াড় আছে এই জায়গাটায়। তাই আমাদের বল পেলেই দৌড়াতে হবে আর সুযোগ নিতে হবে। আমরা খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, যেমনটা সবসময়ই নেই।’

শুধু খেলোয়াড় হিসেবেই নয়, অধিনায়ক হিসেবেও মেসি খুবই পরিতৃপ্ত। কারণ বলেন, ‘পুরো বিশ্বকাপটা জুড়েই আমি খুব খুশি৷ আমার সৌভাগ্য যে, আমি এখন অনেক কিছু ঘটাতে পারছি। এই দলটা খুবই বুদ্ধিদীপ্ত, তারা জানে যখন কষ্ট করার সময় তখন কষ্ট করতে হয়।’

সবশেষে কোচ স্কালোনি ও তার দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মেসি বলেন, ‘আমাদের একদল ভালো কোচিং স্টাফ আছে, ওরা কোনো কিছুই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয় না। তারা ম্যাচে কী হবে সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানিয়ে দেয় এবং ঠিক তা-ই হয়। তাই আমরা কখনো বিভ্রান্ত হই না, কারণ, জানি এরপর কী হবে।’

১৯৯০’র ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার মতোই প্রথম ম্যাচটা হেরে ফাইনালে মেসির দল। তবে অন্তত এই জায়গায় বোধহয় ম্যারাডোনার পাশে বসতে চাইবেন না মেসি!

সূত্র: ডিডাব্লিউ

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS