কোটাবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ঊর্ধ্বতনতন এক পুলিশ কর্মকর্তা-সাংবাদিক-আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানুষসহ শতাধিক আহত হয়েছে। আজ বুধবার (১৭ জুলাই) নগর সংলগ্ন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল ও চৌমাথা এলাকায় এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
দুপুর ১টায় শুরু হওয়া সংঘর্ষ রাত পৌনে ৮টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চলছিল। মুহুর্মুহু টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েও আন্দোলনকারীদের পিছু হটাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। চারদিক দিয়ে ঘিরে পুলিশের উপর বৃষ্টির মতো ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে আন্দোলনকারীরা। টানা প্রায় সাত ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলাকালে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আটকে আছে সব ধরনের যানবাহন। দুর্ভোগে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। সেই সঙ্গে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সংঘর্ষস্থল ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কসহ পুরো নগরে।
কোটা পদ্ধতির সংস্কার এবং রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনায় ছয় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বেলা ১১টার দিকে নগরীর সদর রোডে বিক্ষোভ মিছিল বের করে সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। মিছিল নিয়ে নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে গিয়ে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে তারা। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, বরিশাল কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ইনফ্রা পলিটেকনিকসহ আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল সংলগ্ন মহাসড়ক অবরোধ চলাকালে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ গিয়ে একই মহাসড়কের চৌমাথা এলাকায় তৈরি করে আরেকটি অবরোধ। সেখানেও রাস্তা আটকে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে নানা স্লোগান দিতে থাকে তারা। পুলিশ প্রথমে চেষ্টা চালায় চৌমাথা থেকে শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে দিতে। লাঠিচার্জ করে সরিয়ে দিতে চাইলে পাল্টা পুলিশের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে আন্দোলনকারীরা। এখানে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া সংঘর্ষ চলার মধ্যেই নথুল্লাবাদেও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে পুলিশের। জোড় করে সরিয়ে দিতে চাইলে এখানেও পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করে আন্দোলনকারীরা। ফলে প্রায় ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পুলিশের ধাওয়ার মুখে প্রথমে সরে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যে সংখ্যায় কয়েকগুণ হয়ে নথুল্লাবাদ ও চৌমাথা এলাকার বিভিন্ন অলি-গলিতে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। এরপর আড়াল-আবডাল থেকে চলে পুলিশের দিকে বৃষ্টির মতো ইট পাটকেল নিক্ষেপ। চারদিক থেকে সমন্বিত আক্রমণে হতভম্ভ পুলিশ কিছুটা কোণঠাসা হলে মহাসড়কে উঠে আসে বিক্ষোভকারীরা। শুরু হয় ইট-পাটকেল-টিয়ার সেল-রাবার বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার প্রতিযোগিতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে বহুবার যেমন বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ তেমনি আন্দোলনকারীদের ইট-পাটকেলের মুখে তারাও পিছু হটে বেশ কয়েকবার। হামলার মুখে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল সংলগ্ন একটি রোস্তারাঁয় আশ্রয় নেয়া বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। আটকা পড়লে ওই ভবনেও হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পরে বহু চেষ্টার পর তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করে পুলিশের অন্য সদস্যরা। সংঘর্ষ চলাকালে পুরো এলাকাজুড়ে ব্যারিকেড দেয় ছাত্ররা। ফলে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ যাওয়া বাধাগ্রস্ত হয়। বাধা এড়িয়ে বিকেল ৩টা পৌছায় জল কামানবাহী গাড়ি ও রায়ট কার। তবে কোনো কিছু দিয়েই বিক্ষোভকারীদের পিছু হটাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড আর রাবার বুলেট ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও গুলি করায় নিষেধ ছিল । যে কারণে দীর্ঘ সময় ধরে সংঘর্ষ চললেও এক রাউন্ড গুলিও করেনি পুলিশ।’
বিকেল সাড়ে ৫টায় নথুল্লাবাদ এলাকায় আন্দোলনকারীদের ইটের আঘাতে গুরুতর আহত হন বিএমপির উপ কমিশনার (দক্ষিণ) আলী আশরাফ ভুঞা। এরপর আরও মারমুখি হয়ে উঠে পুলিশ। ইতোমধ্যে সংঘর্ষস্থলে পৌঁছে অতিরিক্ত পুলিশের দল। শুরু হয় দ্বিগুণ মাত্রায় টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড রাবার বুলেট নিক্ষেপ। পুলিশের আক্রমণের তীব্রতায় খানিকক্ষণের জন্য পিছু হটলেও পরে আবার কয়েকগুণ বেশি শক্তি নিয়ে ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করে আন্দোলনকারীরা। এভাবেই চলছিল ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া সংঘর্ষ।
পুরো ঘটনা সম্পর্কে জানতে পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি তারা। বিএমপি কমিশনার জিহাদুল ইসলাম ফোন ধরলেও মিটিংয়ে আছেন এবং পরে কথা বলবেন বলে লাইন কেটে দেন।
নাম-পরিচয় না প্রকাশের শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কয়েক শ’ রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। তবে এখনও যেহেতু সংঘর্ষ চলছে তাই পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো হিসাব দেওয়া যাবে না।’
সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের অন্তত ৩০ সদস্যসহ আহত হয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও। এ ছাড়া সাধারণ পথচারী ও আন্দোলনকারীসহ আহতের সংখ্যা প্রায় দেড়শ। পুলিশি অভিযানের ভয়ে আন্দোলনকারীদের কেউ হাসপাতালে ভর্তি না হলেও বিএমপির উপকমিশনারসহ ১৮ পুলিশ সদস্যকে ভর্তি করা হয়েছে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পুলিশ হাসপাতালে। এ ছাড়া দৈনিক যুগান্তরের বরিশাল ব্যুরো’র ফটো সাংবাদিক শামিম আহম্মেদ, বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির ক্যামেরা পার্সন গোবিন্দ সাহা, ডিবিসির রিপোর্টার ওমর ফারুক সাব্বির এবং স্থানীয় সংবাদপত্র দৈনিক মতবাদের বার্তা সম্পাদক খান রুবেলসহ বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী আহত হন।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সেখানে থেমে থেমে সংঘর্ষ এবং পুরো এলাকা অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply