মুগল আমলের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার আগে ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ধরণ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ হতে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে ছিল কিনা সেই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
কিন্তু জানা যায় যে, ব্যবসায়ীদের পরস্পরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার বিষয়ে তথ্য রয়েছে। এ সময়ে ধনিক শ্রেণি তাদের অতিরিক্ত সম্পদ পিতলের কলসিতে,পাতিলে পুরে মাটিতে পুঁতে রাখত এবং স্বর্ণ বা রৌপ্য পাত্রের গায়ে এ-সংক্রান্ত হিসাব লিখে রাখত। আনুষ্ঠানিক ব্যাংক বা ব্যাংকিং ব্যবসায় না থাকলেও সে সময়ের লোকেরা ব্যাংকিং সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবহিত ছিল। সে সময়ে ঋণ এবং ঋণের অঙ্কের ওপর বাড়তি পরিশোধ (সুদ) বিষয়েও জনগণের অভিজ্ঞতা ছিল।
ঋণ গ্রহণ ও প্রদানের চর্চা বৈদিক আমলেও চালু ছিল। প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ-এ সে সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ইঙ্গিত রয়েছে। সে সময় ব্যাংক ব্যবসায় ছিল মন্দির ও উপাসনালয় কেন্দ্রিক। ঋষি মনুর সময়ে অর্থ ধার করা ও ধার দেয়ার নিয়ম ব্যাংকিং পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হয়। মনুর মতে, ভাল পরিবারের ও চরিত্রের অধিকারী, আইন সম্পর্কে ভাল জ্ঞানসম্পন্ন এবং সম্মানিত ও ধনী আত্মীয় পরিবেষ্টিত লোকের নিকট টাকাপয়সা আমানত রাখা উচিত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নামক গ্রন্থেও ব্যাংকিং ব্যবসায় এবং সুদের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া স্যার রিচার্ড টেম্পল প্রাচীন ভারতে ব্যাংক ব্যবসায় চালানো হতো বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
মুগল শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ বিভিন্ন মূল্যের স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত ছিল। সে সময় মূল্যবান স্বর্ণমুদ্রা অর্থের কারবারিদেরকে এ ব্যবসায়ে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই কারণে নতুন প্রবর্তিত অর্থব্যবসায়ে স্থানীয় কিছু পরিবার যথেষ্ট প্রসিদ্ধি লাভ করে। জগৎশেঠ পরিবারই ছিল শক্তিশালী। সে সময় ওই পরিবারের ঢাকা, হুগলি, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়কেন্দ্রে অর্থব্যবসায়ের শাখা ছিল। মুগল শাসকরা এসব পারিবারিক অর্থব্যবসায়কে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতেন। তা ছাড়া প্রয়োজনবোধে তাদের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করতেন।
মুগলদের টাকশালে জনসাধারণ অল্প খরচে সোনা, রুপা প্রভৃতি মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারত। উক্ত সময়ে মুদ্রা বিনিময়ের সঙ্গে হুন্ডির মাধ্যমেও টাকাপয়সা লেনদেন করা হতো। এছাড়া জমিদারদের নিকট হতে সংগৃহীত সরকারি রাজস্ব সে সময়ে পারিবারিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে পাঠানো হতো। জমিদারগণ অনাদায়ি রাজস্বও পারিবারিক ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে প্রেরণ করত। মুগল আমলে বৃহৎ পুঁজিপতি ব্যাংকার হতে শুরু করে ক্ষুদ্র গ্রাম্য মহাজন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের লোক নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যবসা করত। অর্থাৎ মুগল আমলেই ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার স্বরূপ প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তী তথা ব্রিটিশ আমলে ব্যাংক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান আকারে প্রবর্তিত ও বিস্তৃত হতে থাকে। মুগল আমলেই ১৭০০ সালে ভারতের কলকাতায় দ্য হিন্দুস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় যা এ অঞ্চলের সর্বপ্রথম আধুনিক ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
-আবুল কালাম আজাদ, বাংলাপিডিয়া
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply