শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:১৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ
জুলাই সনদে সকল রাজনৈতিক দলকে অন্তর্ভূক্তির আহবান জানিয়েছে এনসিবি’র চেয়ারম্যান কাজী ছাব্বীর ”জুলাই সনদ” বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার নতুন অধ্যায়: জয়নুল আবদিন ফারুক রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে বিএনপির ৩১ দফা: চুয়াডাঙ্গায় ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুর লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ খুলনায় ন্যাশনাল ব্যাংকের “ম্যানেজার্স মিট” অনুষ্ঠিত জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিলেন জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা চুয়াডাঙ্গায় দৈনিক কালবেলার ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে না এনসিপি জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা শনিবার ব্যাংক খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বস্তির কন্যাশিশুর বোবাকান্না

নাজমুল হোসেন
  • আপডেট : বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বগুড়া প্রতিনিধি: শিশুরা পথে আসুক বা পথে থাকুক, এমনটা কেউ না চাইলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বিপুল সংখ্যক শিশু পথে রয়েছে। একজন শিশুর জীবনে থাকা সব ধরনের ঝুঁকিই আছে পথশিশুদের মধ্যে। এই অবস্থা যেন আরও একটু বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে ভাসমান ও বস্তিতে থাকা মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে।

মোটা দাগে বলতে গেলে ছিন্নমূল মেয়ে শিশুরাই বেশিরভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার। এছাড়া মেয়ে শিশুরাই প্রতিদিন শিকার হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক  নির্যাতনেরও। এসব পথে থাকা বা বস্তিতে থাকা কন্যা শিশুদের অধিকাংশ অপুষ্টিতে ভোগা, নেশায় আসক্ত, চিকিৎসায় অনিহা , ঋতুস্রাবের উৎকণ্ঠা, উচ্চ রক্তচাপ, হীনমন্যতা, বিষন্নতা উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তায়, রোগ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া, নিরাপত্তাহীনতা, বিকৃত যৌনাচার, অপরিকল্পিত গর্ভধারন, গর্ভের বাচ্চা বিক্রি সহ পতিতাবৃত্তিরও অভিযোগ আছে। 

অনুসন্ধানের জন্য বগুড়ার প্রায় কয়েকটি বস্তি এলাকা ঘুরে ও প্রায় ১৫-২০ জন কিশোরী ও বস্তিতে থাকা মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব বিষয়। সরেজমিনে দেখা গেছে এমন চিত্রও। 

বগুড়ার হাড্ডিপট্টি বস্তি এলাকার জুলেখার এক ট্রাক হেলপারের সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত দেখে জোরপূর্বক বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সে। দু’বছর না যেতেই সে এখন কন্যা সন্তানের মা। স্বামীও তাকে ছেড়ে গেছেন সন্তান জন্মের আগেই। এখন নানীকে নিয়ে থাকে খুপড়ি আকৃতির পলিথিনের ঘরে।

বগুড়ার সাতমাথা এলাকায় কোলে আড়াই বছরের সন্তান নিয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চাইতে দেখা যায় এক কিশোরীকে। ১৭ বয়সী এই কিশোরীর নাম জয়নব (ছদ্মনাম)। কথা হয় তার সাথে সে জানায়,’ ইস্টিশন হামি আগে ফুল বেচুচ্ছুনু। মাঝেমধ্যে মানসের থাইক্যা টেয়া (টাকা) চাইয়্যা লিই। কিন্তু অহন এই ছোল হবার পর অশান্তি বেড়ে গেছে। মানসে ছোলের বাপের পরিচয় চাইলে চুপ থাকি! কি করমু ভাই কন?’

জানা যায়, খানিকটা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী জয়নব। বগুড়া রেলস্টেশনের পূর্বপাশে তার সাথে জোরপূর্বক ঘটে অনৈতিক ঘটনা, যা শিশু ধর্ষণ! তার জীবনে নেমে আসে গভীর অন্ধকার। ক’জন যুবক এসে তাকে টেনে নেয় পরিত্যক্ত ট্রেনের বগিতে। মুখ বেঁধে তার ইজ্জ্বত লুটে নেয়। তার ভাস্য মতে, ইজ্জ্বত কি তা বুঝার আগেই ওরা তার ইজ্জ্বত কেড়ে নেয়। সেদিন সে রাত কাঁটিয়েছে ওই ট্রেনেই। রক্ত  ঝরেছিল! সেদিন কাউকে কিছু বলতে পারে নি ভয়ে।

পাঁচ বছর আগে সৎ মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে ঘর ছেড়েছিল জয়নব। কিন্তু বাঁচতে আর পারলো কই! নরপশুর কাছে রক্ষা পায় নি জয়নবের শৈশব-কৈশোর। বরং স্থান পেয়েছে শিশুর কোলে আরেক শিশুর।

বানুর (ছদ্মনাম) বয়স চৌদ্দ। সে জানায়, ‘রাইতের বেলায় ইস্টিশনে, শহরের ভিতরে দশটা এগারোটা পর্যন্ত ফুল বেচি, হাত পাতি। তহন রিকশার ড্রাইভার, ফুটপাথের নেশাখোররা আমগো লইয়া টানাটানি করে। না যাইতে চাইলে গায়ে হাত তুলে। ফুটপাতের পোলাপাইন একলগে তিন চার জন লইয়্যা দূরে চইল্যা যায়। খুব কষ্ট হয় ভাইয়ো। কাম কইরা কেউ পঞ্চাশ টেয়া দেয়, কেউ টেয়াই দেয় না। পুলিশের কাছে বিচার দিলে উল্টা ধমক দেয়। কয় তোরা খারাপ মাইয়্যা। যা! ‘ 

ফুটপাত বা দোকানে কাজ অথবা ময়লা কুড়ানো কিংবা ফুল বিক্রি করে আর দশজন ছিন্নমূল ছেলের মতো কাটে না বারো বছরের আখি তারা’র জীবন। একই কাজ করতে গিয়ে, আখিকে শুনতে হয় নানা কটূ কথা। মারধোরেরও শিকার হতে হয় কখনো কখনো। 

আরেক পথশিশু সুমি (ছদ্মনাম) থাকে বগুড়ার বস্তি এলাকার পালিত মায়ের কাছে। জানে না আসল মায়ের পরিচয়। সে জানায়, অনেক মানুষ খারাপ কথা বলে, থাপ্পড় মারে চড় মারে। অনেক রিকশাওয়ালা দেয় নানা ধরনের কুপ্রস্তাব। শুধু সুমি নয়, তার মতো এমন অনিরাপদ জীবন পার করছে বস্তিতে থাকা অনেক কন্যা শিশু। 

‘আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা খুললেই যেখানে দেখা যায় পিতামাতার নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেও শিশুরা ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে; সেখানে খোলা আকাশের নিচে বাস করা এই অরক্ষিত পথশিশুরা যে প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা বলা বাহুল্য’ বলে জানান উন্নয়ন কর্মী ও প্রশিকা মানবিক কেন্দ্রের চেয়্যারম্যান রোকেয়া ইসলাম। 

তিনি আরো বলেন , ‘ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক বেশি। তারা অনেক সময় গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। এছাড়াও তারা শিকার হচ্ছে নানা ধরনের বড় বড় অসুখের। একজন ছেলের থেকে মেয়েদের বেশি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ জায়গায় থাকা দরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে খোলা রাস্তায় নোংরা আর অনিরাপদ পরিবেশের জন্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। প্রশিকা এখন তাদের নিয়ে কাজ করছে। ’

বগুড়ার মহিলা ও শিশু বিষয়ক কর্মকতা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একজন পথশিশু যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজে বুঝবে সে সক্ষম, যতক্ষণ না ট্রেনিং এর মাধ্যমে সে বুঝবে তার (শিশু) অধিকার সম্পর্কে; পড়াশোনা করে বড় হতে হবে, তারপর চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ঠিক তখন সে পারবে ওই পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বের করে আনতে।’ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয় বরং সমাজের সবাইকে এদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

বস্তিতে থাকা এক বয়জেষ্ঠ নারী দিপালি জানাচ্ছিলেন তার ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা তিনি জানান, আগের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ ছিল, কেউ দুমুঠো খাবার দিলেই হতো ‘স্বামি’ ; বিকিয়ে দিতো নিজেকে। সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে বিরুপ অবস্থায় পড়তে হয়। যদিও এক সময় কষ্টের গল্প বলতে এগিয়ে আসে এই কিশোরীরা নিজেই।

পরিবার বিচ্ছিন্ন অনেক শিশুদের কথিত বাবা মা আশ্রয় দেন আর ব্যবহার করে নিজের মতো করে। ওই শিশু-কিশোরীদের দিয়ে কখনো বা গর্ভের সন্তান বিক্রি কখনো বা কোন দম্পতির সন্তান গর্ভে ধারণ করে থাকে টাকার বিনিময়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুযোগ বুঝে অন্যত্র ভাড়া দেয় সহ টাকার বিনিময়ে বিক্রিরও অভিযোগ আছে। 

প্রতিবেদনের এসব সূত্র খুঁজতে খুঁজতে কথা হয় বগুড়ার চেলোপাড়া বস্তির রোমেচা বেওয়ার সাথে। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। তিনি জানালেন কিছু দিন আগেই এই বস্তিতে এক সন্তান জন্মের পরপরই টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। জানা যায়, চুক্তির ভিত্তিতে সন্তানসম্ভবা কিশোরীকে নিঃসন্তান দম্পতির পক্ষ থেকে প্রতিদিন খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়। সন্তান ভূমিষ্ঠের পর কিশোরী নগদ টাকা পায়। জানা যায়, নবজাতকের দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে লিঙ্গভেদে ও গায়ের রং অনুসারে। মেয়ে হলে কম আর ছেলে হলে বেশি দাম। এছাড়া পতিতালয়ে বস্তির কিশোরীদের চাহিদা বেশিও বলে জানান এই নারী। 

তিনি বলেন, ‘কত কি হয় বাবা এটি (এখানে)। সব টেয়ার ( টাকা) খেলা! টেয়া হলে সব হয়! মেলা ( অনেক) বেটিছোলের ওগ্লে খারাপ কাজ করতে গিয়ে ছোল পেট’ত আটকে গেলে; পেট’ত থাকতেই বেইচ্যা দেয়। উপায় কি বাবা কও! ও ছোল হলেই কষ্ট, এমনি তো দিন আনে দিন খাওয়া তার উপ্রে ছোল পালা। কি আর কমু বাবা!  জীবন হামাকের (আমাদের) কঠিন। সহজ লয়! ’

বগুড়ার বেসরকারি এক এনজিও’র সাবেক কর্মকর্তা মুহম্মদ ফজলুল হক বলেন, ‘সাম্প্রতিক যৌন নির্যাতন বিরোধী নীতিমালা নিয়ে বেশ আলোচনা হলেও পথশিশু ও কিশোরী দের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। পথে-ঘাটে রাত্রি যাপনের ফলে তারা নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অথচ তাদের নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোন ভাবনা নেই।’ তার মতে, এর ফলে এসব শিশুদের এইডসসহ বিভিন্ন যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে অনেকাংশেই।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি আরো জানান, ‘এর ফলে এসব শিশুদের এইডসসহ বিভিন্ন যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে অনেকাংশেই। যৌন নির্যাতন ছাড়াও অশিক্ষা, অজ্ঞতা, অবহেলা ও তত্ত্বাবধানের অভাবে বেড়ে উঠাসহ নানা কারণে পথশিশুরা যৌন কার্যকলাপে জড়িয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসকল মেয়ে শিশুরা নিয়োজিত হচ্ছে পতিতাবৃত্তিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না বুঝে এসব সমাজবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা। পরবর্তীতে জীবনধারণের প্রয়োজনের টাকা আয়ের পথ হিসেবে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিতে বাধ্য হয় তারা।’ 

তথ্য বলছে, দেশের ভাসমান পতিতাদের অধিকাংশই ছিন্নমূল শিশু। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ৬১ লাখ শিশুশ্রমিকের মধ্যে মেয়েদের শতকরা ৩২ জন পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত। জানা গেছে, যৌন নির্যাতনের শিকার এসব মেয়ে শিশুদের দেখার মতো সরকারের কোন প্রতিষ্ঠান নেই। নামে মাত্র কয়েকটি শিশুসদন থাকলেও তা পথ শিশুদের প্রয়োজনে আসে না।

এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব। অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা। তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে। সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব। 

শিশুরাই হচ্ছে শিশুদের পিতামাতা! অকাল মাতৃত্বের কারণে কিশোরীর জীবনও তো বিপন্ন হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- পথে থাকা কিশোরীও হয়ত তার সন্তানের প্রকৃত বাবার পরিচয় বলতে পারবে না। কারণ সংঘবদ্ধ নেশা করা কিশোরদের সবাই একজন কিশোরীকে স্ত্রীর মতো ব্যবহার করে। 

আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে। শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এসব সনদ ও আইনে। কিন্তু আমাদের দেশের পথশিশুরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশটির সর্বশেষ জনশুমারিতে ভাসমান মানুষ সম্পর্কে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, দেশে চার লাখের মতো পথশিশু রয়েছে, যার অর্ধেকই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকায়। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। ঢাকার হিসাব অবশ্য তাদের কাছে নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই ছয় লাখ পথশিশু রয়েছে। সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখ। তবে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে শুধু মাত্র মেয়ে পথশিশুর সংখ্যা ১ কোটি ৯৭ লাখ। এই মেয়ে শিশুদের বেশিরভাগই এ বয়স থেকেই যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। 

জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ এবং শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়। জাতিসংঘ জানায়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নদীভাঙ্গন, শৈশবে বাবা-মায়ের অকালমৃত্যু, পিতা-মাতা সংসার পরিচালনায় অক্ষমসহ নানা কারণে পথশিশু তথা সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৭ নভেম্বর ‘বিশ্ব শিশু দিবস-২০২২’ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের আয়োজনে (বিএসএমএমইউ) ‘শিশু স্বাস্থ্য, বিকাশ ও সুরক্ষা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিভাগটির বিগত পাঁচ বছরে শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, শিশু নির্যাতনের ফলে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ ১৬ দশমিক ২ শতাংশ , যার মধ্যে মেয়ে শিশুর সংখ্যা বেশি।  

বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের যৌন ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আসলাম আহসান জানান, অনিরাপদ ও অপ্রাপ্ত বয়সে যৌন মিলনের ফলে শারীরিক ভাবে ঝুঁকি বেশি। কিশোরীদের যৌনাঙ্গের মিউকাস মেমব্রেন পুরোপুরি তৈরি হয় না যার কারণে জোরপূর্বক যৌনাঙ্গে অনুপ্রবেশের ফলে যে ক্ষত সৃষ্টি হয় তা শরীরে এইচআইভি জীবাণু প্রবেশে সহায়তা করে। তাছাড়া রোগ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার মতো বিষয় নজরে এসেছে। যৌনাঙ্গে সংক্রমণও হতে পারে। 

বগুড়া সরকারি কলেজের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক মুহম্মদ রকিব উদ্দিন বলেন, ‘শৈশব বা কৈশোরে জোরপূর্বক যৌনমিলনের শিকার হলে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বহুগামিতা, অনিরাপদ যৌন মিলন, যৌনকর্মী হিসেবে জীবন অতিবাহিত করার প্রবণতা তৈরি হয়। এছাড়া হীনমন্যতা, বিষন্নতা উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা, নিরাপত্তাহীনতা সহ আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। ’

যখন এসব পথ শিশুদের জীবন ও জীবিকার অবস্থা এমন! তখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় যৌন হয়রানি। এসব নিয়ে কাজ করা শিশু সংগঠন- ‘নতুন কুড়ির’ সমন্বয়ক সুজাউদ্দৌলা বলেন, ‘১৮ বছরের নিচে যে কোনো শিশুকে শুধু ধর্ষণ বা যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করাকেই শিশু যৌন নির্যাতন বলা হয় তা নয়। এর সঙ্গে, শিশুর সংবেদনশীল স্থানে হাত দেওয়া, গোপন স্থান দেখার জন্য শিশুকে তার কাপড় খুলতে বাধ্য করা, অশ্লীল ছবি তুলতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক খারাপভাবে চুমু খাওয়া, অশ্লীল ছবি দেখানো– এসবও যৌন নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে। যা বস্তিতে বসবাস করা মেয়ে শিশুর সাথে অহরহ ঘটে চলছে।’ 

সেইভ দ্য চিলড্রেনের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে যেসব শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয় তাদের ৫২ ভাগ মেয়েশিশু আর ৪৮ ভাগ ছেলেশিশু। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশের মেয়ে পথশিশুরা প্রতিনিয়তই নানা রকম যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। একটু বড় হতেই এদের মধ্যে বেশিরভাগ পাচার হয়ে যায় ভারতসহ দেশের অভ্যন্তরেই, যৌনপল্লীগুলোতে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS