নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আবুল কাশেমের চোখে তখন শুধুই পানি। একটা সময় ছিল যখন সে বন্ধুদের নিয়ে ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের কথা বলতো। “আমরা একদিন এই দেশটা বদলে দেব,”—এই আশায় বুক
বাঁধতো। কিন্তু জুলাই ২০২৪-এর সেই বিভীষিকাময় দিনে তার স্বপ্নগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।
তাহরিকা ছিল রাজপথের সামনের কাতারে। সে ছিল এককণ্ঠ প্রতিবাদের অংশ। ১৫ জুলাই ঢাকার মলচত্বরে পুলিশের লাঠিচার্জে সে যখন পড়ে যায়, তখন বন্ধুরা তাকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু ওর বুকের ব্যথাটা আর কমে না। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রাতে ঘুমাতে গেলেই তার মনে পড়ে, কিভাবে রাব্বিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছিল। এখনো হঠাৎ সাইরেনের শব্দে সে কেঁপে ওঠে।
শুধু আবুল কাশেম নয়—তাওহীদা, সুমাইয়া, ওসমান, ফিরোজ, সৃজন, হৃদয়, সাবিনা, নূরনবী, মুনিয়া, শাকিল, মোয়েম, রিচি—তারা সবাই সেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সৈনিক। কারো চোখে পলাশী মোড়ের ধোঁয়াশা আজও পরিষ্কার, কেউ হাসপাতালে পড়ে থাকা রক্তাক্ত শরীরের গন্ধ ভুলতে পারে না। এই অস্পষ্ট, অথচ প্রবল যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতেই সফরন ফাউন্ডেশন আয়োজন করে ‘নির্বাণ’ কর্মশালা।
শনিবার, ২১ জুন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই কর্মশালায় আলোচকরা আন্দোলনকারীদের মানসিক সুস্থতা, আত্ম-পরিচর্যা ও পুনর্বাসনের গুরুত্ব তুলে ধরেন।কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যোদ্ধারা, যারা নিজেদের সাহস ও আত্মত্যাগ দিয়ে ন্যায়ভিত্তিক সমাজের ভিত্তি গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজপথের লড়াই শেষ হলেও মানসিক যুদ্ধ এখনো চলছে।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন:
● ড. মোহাম্মদ তোজাম্মেল হক, প্রক্টর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
● সালাহ উদ দীন আহমেদ, সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BERC)
● আসিফ বিন আলী, পিএইচডি গবেষক, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং স্বাধীন সাংবাদিক
● আশিফ এনতাজ রবি, লেখক ও কাহিনিকার
সফরন ফাউন্ডেশনের পক্ষে সিইও সৌমিক পি. দত্ত স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন।
কর্মশালায় মনোবিজ্ঞনী ও মনোচিকিৎসকগণ দিনব্যাপী সর্বাধুনিক মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে জুলাই অভ্যুথানে অংশগ্রহণকারীদের আত্নযত্ন নেয়ার পদ্ধতি শিখন ও তাদের মানসিক শক্তিকে দৃঢ়করণে লক্ষ্যে অংশগ্রহণমূলক সেশন পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন হেলথ ইকুইটি ইনিশিয়েটিভ (হেই) মালয়েশিয়ার ক্লিনিক্যাল সুপারভাইজর জোহরা পারভীন এবং ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আজিজুল ইসলাম। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক তালুকদার এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক রাইহানা শারমিন সম্পুর্ন কর্মশালাটি পরিচালনা ও সঞ্চালনা করেন।
সহযোগী সংগঠনসমূহ কর্মশালাটি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন:
● ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন (CAMPE)
● সংযোগ ফাউন্ডেশন
সহযোগী হিসেবে ছিলেন:
● কগনিটিভলি ইয়োর্স (ইভেন্ট পার্টনার)
● গ্রো – GROW (রিসার্চ পার্টনার)
আয়োজকদের মতে, বৈষম্যমুক্ত ও শোষণহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে আত্মত্যাগী তরুণদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করাই এই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য। তাদের জন্য এমন সহায়তা ও পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে, যেন তারা আবারও স্বপ্ন দেখতে পারে, গড়ে তুলতে পারে এক নতুন বাংলাদেশ।
ড. মোহাম্মদ তোজাম্মেল হক বলেন, “আপনারা যে সাহস দেখিয়েছেন জুলাই আন্দোলনে, সেটা আমাদের প্রজন্ম পারিনি।” আসিফ বিন আলী ও আশিফ এনতাজ রবি বলেন এই দেশের এলিট শ্রেণি কখনো সাধারণ মানুষের কথা ভাবেনি। এখন ছাত্রদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে, সমাজ পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে। তাঁরা অংশগ্রহণকারীদের ঐক্য, সহনশীলতা, ও সামাজিক ন্যায়বোধ বজায় রাখার আহ্বান জানান।
সফরন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সৌমিক পি দত্ত জানান, জুলাই অভ্যূত্থানে আহতরাএখনও বড় ধরনের ট্রমার মধ্যে আছেন। তাদের শারিরীক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। কর্মশালায় যারা অংশগ্রহণ করছেন, আশা করছি, তারা নিজেরাই নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে সক্ষম হবেন। জুলাই মাস থেকেই আমরা আহতদের জন্য ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণ কর্মসুচি শুরু করছি, যাতে আমাদের তরুণরা নিজেদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে পারেন।
একটি নতুন বাংলাদেশের পথে এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি (৩০জন) এবং ১৬ মে (৩০জন) অনুরূপ কর্মশালার আয়োজন করেছিল সফরন ফাউন্ডেশন। সেখানেও অংশগ্রহণ করেছিলেন মোট ৬০ জন জুলাইযোদ্ধা।আয়োজকরা জানান, এমন সহায়ক ও পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে—যাতে তারা আবারও স্বপ্ন দেখতে পারেন, এবং নতুন এক বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হন।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply