মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৪ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের জলবায়ু অর্থায়ন: ঋণের বোঝা না কি ন্যায্যতার প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

বাংলাদেশ এমন এক ভূখণ্ড, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষের লড়াই প্রতিদিন নতুন রূপ নেয়। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার বদ্বীপে অবস্থিত এই দেশটি বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রথম সারির শিকার। মাত্র কয়েক মিটার উচ্চতার এই ভূমি প্রতিবছরই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থানে বিপর্যস্ত হয়। ১৬ কোটি মানুষের এই জনবহুল দেশে কৃষিই জীবনের কেন্দ্র, অথচ কৃষিই এখন জলবায়ু ধাক্কায় সবচেয়ে নাজুক। একদিকে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও খরা, অন্যদিকে চরম তাপমাত্রা-সব মিলিয়ে ফসল, খাদ্যনিরাপত্তা ও জীবিকার ভিত্তি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।

এই সংকট থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি জলবায়ু অর্থায়ন। বাংলাদেশ নিজস্ব বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF) গঠন করেছে, এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড (GCF), অ্যাডাপ্টেশন ফান্ড, ও LDCF থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। কিন্তু সহায়তার বেশিরভাগই ঋণ-অনুদান নয়। ফলে অভিযোজন সহায়তা আসছে ঋণের ভারে বাঁধা হয়ে। জলবায়ুর শিকার দেশই হয়ে পড়ছে ঋণের বোঝায় জর্জরিত। Climate Debt Risk Index (CDRI-2025) অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন এমন দেশগুলোর শীর্ষে, যাদের জলবায়ু অর্থনীতি নিজেই জলবায়ুর ক্ষতিপূরণে ঋণগ্রস্ত।

অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা                                                                                                            ২০০২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মোট ১.৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন পেয়েছে-যেখানে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP) অনুসারে প্রয়োজন ২৩৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, প্রয়োজনের এক শতাংশও আসেনি। অন্যদিকে, প্রশমন খাতে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (NDC 2.0)-এর আওতায় প্রয়োজন ১৪৩.৭১ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু বাস্তবে পাওয়া গেছে মাত্র ৩.৩৯ বিলিয়ন (২.৩৫%)। এই অপ্রতুল অর্থায়ন বাংলাদেশের নিম্ন-কার্বন উন্নয়ন লক্ষ্যকে পিছিয়ে দিচ্ছে এবং জলবায়ু সংকটকে আরও গভীর করছে।

অর্থ প্রতিশ্রুতির বাস্তবচিত্র                                                                                                                          বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি ও বিতরণের অনুপাত (Disbursement-to-Commitment Ratio) বর্তমানে ০.৬৩-বিশ্ব গড় ০.৫৭-এর তুলনায় কিছুটা ভালো হলেও এখনও যথেষ্ট নয়। প্রতিশ্রুত অর্থের বড় অংশই কাগজে থেকে যাচ্ছে। বহুপাক্ষিক তহবিলে এ অনুপাত মাত্র ০.৩২, যা এলডিসি গড় ০.৫-এর নিচে। অর্থাৎ, অঙ্গীকার আসে, কিন্তু অর্থ পৌঁছায় না।

ঋণের ফাঁদে জলবায়ু সহায়তা                                                                                                                        বাংলাদেশের ঋণ-অনুদান অনুপাত (Debt-to-Grant Ratio) সবচেয়ে উদ্বেগজনক-২.৭, যেখানে বৈশ্বিক গড় মাত্র ০.৭। অর্থাৎ প্রতি ১ ডলার অনুদানের বিপরীতে ২.৭ ডলার ঋণ নেওয়া হচ্ছে। বহুপাক্ষিক অর্থায়নেও অনুপাত ০.৯৪, যা এলডিসি গড় ০.১৯-এর প্রায় পাঁচগুণ। এই ঋণনির্ভর সহায়তা কার্যত দেশের জলবায়ু নীতি ও রাজস্ব স্থিতিকে বিপন্ন করছে। উন্নত দেশের দায় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশকেই দিতে হচ্ছে ঋণের সুদ-এ এক অর্থনৈতিক বৈপরীত্য।

অভিযোজন বনাম প্রশমন: ভারসাম্যহীন ব্যয়নীতি                                                                                          মোট জলবায়ু অর্থায়নে বাংলাদেশের অভিযোজন-প্রশমন অনুপাত (Adaptation-to-Mitigation Ratio) মাত্র ০.৪২, যেখানে এলডিসি গড় ০.৮৮। অর্থাৎ, প্রশমনে ব্যয় বেশি, অভিযোজনে কম। অথচ অভিযোজনই মানুষের জীবন রক্ষার ঢাল। বহুপাক্ষিক অর্থায়নে অনুপাত কিছুটা ভালো (০.৯), কিন্তু তাও কাঙ্ক্ষিত নয়। তুলনায় সোমালিয়া অভিযোজন খাতে ১২ গুণ বেশি ব্যয় করে; আর ইকুয়েটোরিয়াল গিনি প্রায় সবই প্রশমনে। এই বৈষম্য দেখায়-বিশ্বব্যাপী অর্থপ্রবাহ এখনো মানুষের টিকে থাকার নয়, বরং নিঃসরণের হিসাবের দিকে ঝুঁকে আছে।

বাংলাদেশের জলবায়ু ঋণ: অদৃশ্য ভার

  • জলবায়ু ঋণ-জিডিপি অনুপাত: ০.০০৭৭, যা বৈশ্বিক গড় ০.০১২৫-এর নিচে, কিন্তু প্রতি বছর দুর্যোগ মোকাবিলায় এই ঋণ নতুন করে বাড়ছে।
  • মাথাপিছু ঋণ-আয় অনুপাত: ০.০০৮, যা নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর জন্য অপ্রতিরোধ্য চাপ।
  • মাথাপিছু ঋণ-CO₂ নিঃসরণ অনুপাত: ২৯.৫২ ডলার/CO₂, প্রায় বৈশ্বিক গড়ের সমান-দেখায়, যারা কম দূষণ করে তারাই বেশি ঋণ শোধ করছে।
  • মোট মাথাপিছু জলবায়ু ঋণ (২০০২-২০২৩): ৭৯.৬১ ডলার, যা এলডিসি গড়ের তিনগুণেরও বেশি।
  • CDRI-2025 স্কোর: ৬৫.৩৭ (উচ্চ ঝুঁকি)-২০৩১ সালে সামান্য বেড়ে ৬৫.৬৩ হওয়ার পূর্বাভাস। অর্থাৎ, অর্থনীতি বাড়ছে, কিন্তু ঝুঁকি কমছে না।

খাতভিত্তিক অর্থায়নের প্রবণতা

  • জ্বালানি খাতে বরাদ্দ সর্বাধিক (২.৫৪ বিলিয়ন ডলার)-কিন্তু প্রায় পুরোটা ঋণ (loan-to-grant ratio: ১১.৯৯) ও প্রায় সম্পূর্ণ প্রশমনমুখী।
  • কৃষি, বন, মৎস্য ও দুর্যোগ প্রস্তুতি খাতের বরাদ্দ কম হলেও পুরোপুরি অনুদাননির্ভর।
  • পানি ও পরিবেশ সংরক্ষণ খাতে অনুদান আছে, কিন্তু বিতরণ কার্যকারিতা কম।
  • পরিবহন ও সংরক্ষণ খাতে ঋণ-অনুদান অনুপাত এক হাজার ছাড়িয়েছে, ফলে ঋণচাপ ভয়াবহ।
  • স্বাস্থ্য ও শিল্প খাতে বরাদ্দ প্রায় নেই বললেই চলে-যা মানবিক অভিযোজনের ঘাটতি প্রকাশ করে।

সমগ্র চিত্রে দেখা যায়-অর্থপ্রবাহের মূল লক্ষ্য প্রশমন ও অবকাঠামো; কিন্তু মানুষের স্থিতিস্থাপকতার জায়গা এখনও উপেক্ষিত।

বাংলাদেশের ঘোষিত জলবায়ু অর্থায়নের প্রায় ১৯ শতাংশ (০.৮৮ বিলিয়ন ডলার) প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু সহায়ক নয়-এ অর্থ কয়লা ও গ্যাস প্রকল্পে (যেমন মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট) ব্যবহৃত হয়েছে। এই ভুল শ্রেণিবিন্যাসের ফলে ঋণ-অনুদান অনুপাত ২.০৭ থেকে ২.৭০-এ বেড়েছে। অর্থাৎ, তথাকথিত ‘সবুজ অর্থায়ন’-এর আড়ালেও লুকিয়ে আছে জীবাশ্ম জ্বালানির ছায়া।

মূল বার্তা                                                                                                                                                বাংলাদেশের জলবায়ু অর্থায়নের চিত্র এক গভীর বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি-অল্প অর্থ, বেশি ঋণ, কম অভিযোজন, আর ক্রমবর্ধমান আর্থিক ঝুঁকি। উন্নয়ন ব্যাংকগুলো সহায়তা দিলেও তার কাঠামো এমন যে, তা আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতিকেই দুর্বল করে তোলে। অতএব, সময় এসেছে ঋণনির্ভর নয়, অনুদাননির্ভর জলবায়ু অর্থায়নের দাবি পুনরুজ্জীবিত করার-যেখানে “Polluter Pays”নীতি কার্যকর হবে, এবং প্রকৃতির অধিকারের ন্যায্যতা হবে বৈশ্বিক অর্থনীতির নতুন ভিত্তি।

নীতিগত সুপারিশ

উন্নত দেশসমূহের জন্য

  • ঋণের পরিবর্তে অনুদান: অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ অনুদাননির্ভর সহায়তা।
  • ঋণমুক্তি ও ন্যায্যতা: “Debt-for-Nature Swap” ও “Reparative Justice”-এর মাধ্যমে দায় স্বীকার।
  • Earth Solidarity Fund: ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য শর্তহীন বৈশ্বিক তহবিল।
  • দায়িত্বশীল উত্তর: উন্নত দেশগুলোকে প্রকৃত ন্যায্যতার ভিত্তিতে অর্থ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

উন্নয়ন সহযোগী ও বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানসমূহ

  • Grant-First পদ্ধতি: MDBs ও UNDP-এর উচিত অভিযোজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ঋণ নয়, অনুদান প্রদান।
  • NRLG-ভিত্তিক সংস্কার: বিকেন্দ্রীকৃত অর্থায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধকরণ, এবং “CIF-Nature, Climate and People Fund” গঠন।
  • স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: স্থানীয় পর্যায়ে MRV ও আর্থিক প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধি।

বাংলাদেশ ও এলডিসি দেশসমূহের জন্য

  • BCCTF পুনর্গঠন: এটিকে Bangladesh National Resilience Fund (BNRF)-এ রূপান্তর, যেখানে অর্থ আসবে কার্বন ট্যাক্স, সামাজিক বিনিয়োগ ও দাতব্য খাত থেকে।
  • জনসম্পৃক্ত অভিযোজন: স্থানীয় সম্প্রদায়কে পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের কেন্দ্রে আনতে হবে।
  • উদ্ভাবনী অর্থনীতি: কার্বন মূল্যায়ন, ফিলানথ্রপি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অর্থের ঘাটতি পূরণ করতে হবে (যেমন: জ্বালানি খাতে প্রয়োজন ১৩৭.৫ বিলিয়ন ডলার, বরাদ্দ মাত্র ২.৫৪ বিলিয়ন)।

বাংলাদেশের জলবায়ু অর্থনীতি আজ ন্যায্যতার মোড়ে দাঁড়িয়ে। দেশটি কার্বন নিঃসরণের দায় বহন করে না, অথচ ভোগ করছে তার ফল। এখন প্রয়োজন এক নতুন বৈশ্বিক অঙ্গীকার-যেখানে ঋণ নয়, থাকবে দায়বদ্ধতা; অনুদান নয়, থাকবে ন্যায়বিচার।

প্রকৃতির জন্য ন্যায়বিচার, মানুষের জন্য স্থিতি-এই হোক বাংলাদেশের জলবায়ু অর্থনীতির নতুন সংজ্ঞা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS