বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০২:০১ পূর্বাহ্ন

খেলাপির কবলে পড়া তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভগ্নাদশা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২২

দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উচ্চ খেলাপির কবলে পড়েছে ১৬টি প্রতিষ্ঠান, যাদের বিতরণকৃত মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার ১০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে পুঁজিবাজারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১১টি। খেলাপি ঋণের কবলে পড়া এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও ধীরে ধীরে তলানিতে নামছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উচ্চ খেলাপিতে ধুঁকতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- জিএসপি ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, বিআইএফসি, সিভিসি ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, এফএএস (ফাস) ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, মাইডাস ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ও উত্তরা ফাইন্যান্স। এর মধ্যে বিআইএফসি, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, এফএএস (ফাস) ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, মাইডাস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ও উত্তরা ফাইন্যান্স পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।

এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার জের ধরে কমে যাচ্ছে এর শেয়ারদর। এসব কোম্পানির মধ্যে বিআইএফসির শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে সাত টাকা ৩০ পয়সায়। এক সময় এই শেয়ারের চাহিদা তুঙ্গে থাকলেও কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে দিন দিন এর চাহিদা কমতে থাকে। এক সময় যা অভিহিত দরের নিচে চলে আসে। এখনো প্রায় প্রতিদিনই এই শেয়ারে ক্রেতার অভাব দেখা যায়। যার জের ধরে বছরের একটা সময় এ শেয়ার ৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে কেনাবেচা হয়।

একইভাবে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের শেয়ার বর্তমানে পাঁচ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে। একসময় ভালো আর্থিক অবস্থা থাকলেও বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের অবস্থা নড়বড়ে। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়েছিল ৭১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন চিত্র পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ থাকার কারণে গত এক বছরের মধ্যে এ শেয়ার সর্বনিম্ন তিন টাকা ১০ পয়সায় কেনাবেচা হয়। যদিও এর মধ্যে দর এক পর্যায়ে ১০ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হতে দেখা যায়।

একই অবস্থা এফএএসের (ফাস)। একসময় এর শেয়ার চাহিদা ছিল বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের শীর্ষে। কিন্তু খেলাপি ঋণের চাপসহ বিভিন্ন কারণে দিন দিন এর আর্থিক অবস্থা করুণ হতে থাকে। ২০২০ সালে এই প্রতিষ্ঠানের লোকসান দাঁড়ায় ২১৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর আগের বছর এই প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ছিল ১৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির লোকসান বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এর জের ধরে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশও দিতে পারছে না। ফলে বিনিয়োগকারীরা এই শেয়ারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এক বছর আগে এই কোম্পানির প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হচ্ছিল ১১ থেকে ১২ টাকার মধ্যে। বৈরী সময়ের প্রভাবে বর্তমানে এই শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে পাঁট টাকা ৬০ পয়সায় থেকে ৭০ পয়সার মধ্যে।

এদিকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ারদরও তলানিতে নেমে গেছে। গত এক বছরের লেনদেন চিত্রে দেখা যায় এই সময়ে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার সর্বোচ্চ ১১ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়। আর এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার সর্বনিম্ন চার টাকা ২০ পয়সায় কেনাবেচা হয়। বর্তমানে এই শেয়ার পাঁচ টাকা ৭০ পয়সায় কেনাবেচা হচ্ছে। একইভাবে নিম্নমুখী অবস্থায় রয়েছে মাইডাস ফাইন্যান্সের শেয়ারদর। বাজারচিত্রে দেখা যায় সর্বশেষ এই কোম্পানির শেয়ার ১৪ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন হয়। বর্তমানে এ শেয়ারের গত এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এদিকে গত এক বছরে মাইডাস ফাইন্যান্সের প্রতিটি শেয়ার ২৫ টাকা ৮০ পয়সায় কেনাবেচা হতে দেখা যায়।

অন্যদিকে আর্থিক খাতের কোম্পানি প্রিমিয়ার লিজিংয়ের শেয়ারদরও নিম্নমুখী অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে এই কোম্পানির প্রতিটি শেয়ার কিনতে খরচা হচ্ছে সাত টাকা ২০ পয়সা থেকে সাত টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে। অথচ এক বছর আগেও এর প্রতিটি শেয়ার কিনতে গুনতে হয়েছে ১৪ থেকে ১৫ টাকা। একইভাবে প্রাইম ফাইন্যান্সের শেয়ারদর রয়েছে নিম্নমুখী অবস্থায়। সর্বশেষ এ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয় ১৩ টাকা ৩০ পয়সায়। এক বছর আগে এ শেয়ার ২০ থেকে ২১ টাকায় কেনা বেচা হতে দেখা গেছে। একইভাবে নিম্নমুখী রয়েছে তালিকায় থাকা বেশির ভার প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর।

জানা যায় চরম অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ডুবতে বসেছে। খাতটির ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সবগুলো চরম সংকটে রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদেনে উল্লেখ করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছর আগে ৬৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে ১০ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা, আর্থিক খাতের সার্বিক বিবেচনায় যা মোট ঋণের ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

এর আগে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপি কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে খেলাপির হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়া হয়। কারণ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উচ্চ খেলাপিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। নির্দেশনা দেয়ার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণখেলাপির হার আরো বাড়তে শুরু করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

জানা যায়, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুসারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, দেশের পুঁজিবাজারে অর্থায়নসহ ব্যাংকগুলোর সাধারণভাবে উৎসাহ নেই, এমন খাতে অর্থ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৩ সালে সরকার ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩’ প্রবর্তন করে। ব্যাংকিং কোম্পানির মতোই এসব প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অর্পিত হয়। দেশে বর্তমানে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলেও বর্তমানে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান হাবুডুবু খাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মতো দৈনন্দিন লেনদেন করতে পারে না। আগে এসব প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন ছয় মাসের জন্য স্থায়ী আমানত গ্রহণ করতে পারত। পরে এদের ব্যবসা বৃদ্ধির কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বনিম্ন তিন মাসের জন্য আমানত গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। এতে আর্থিক খাতে আরো অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে।

অনিয়মের মাধ্যমে সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে। নাজুক এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে মন্দ ঋণ এই খাতের পরিস্থিতিকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, এটি গত এক দশকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। কোভিড মহামারির মধ্যে সরকারি এবং বেসরকারি মিলে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সবগুলো চরম সংকটে রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে কোনো কারণে যদি সেইসব প্রতিষ্ঠানের আয় কমে যায় বা আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তাহলে ওই কোম্পানির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে যায়। এছাড়া সন্তোষজনক লভ্যাংশ দিতে না পারলেও সেই কোম্পানি থেকে বেরিয়ে আসেন বিনিয়োগকারীরা।

একই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অনিয়মের কারণে বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে আস্থা ওঠে গেছে। যার ফলে এই খাতের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গেছে।

প্রসঙ্গত, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে বা আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে তখন বিনিয়োগ ঝুঁকি এড়াতে এসব কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ তুলে নিতে দেখা যায়। যার জের ধরে এসব শেয়ারদর কমে যায়।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো খবর »

Advertisement

Ads

Address

© 2025 - Economic News24. All Rights Reserved.

Design & Developed By: ECONOMIC NEWS