নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রেলপথ সচিব বরাবর বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির সভাপতি মোঃ মনিরুজ্জামান মনির স্বাক্ষরিত এক স্মারকলিপির মাধ্যমে রেলওয়ে মহাপরিচালককে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘অপসারণের সিদ্ধান্ত’ প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়েছে রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি। সোসাইটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক একজন অভিজ্ঞ, নিয়মিত ও বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত পেশাদার কর্মকর্তা, যাঁর মেয়াদ ২০২৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অডিট আপত্তিকে ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু করার পেছনে ‘প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার ও অপারদর্শিতা’ কাজ করছে বলে উল্লেখ করা হয়।
স্মারকলিপিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) একজন অভিজ্ঞ ও নিয়মিত নিয়োগপ্রাপ্ত পেশাদার কর্মকর্তা, যাঁর চাকরির মেয়াদ আইন অনুযায়ী ২০২৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। অথচ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি অডিট আপত্তিকে ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ বলে চিহ্নিত করে তাঁকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে মর্মে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেয়েছি। এই সিদ্ধান্ত শুধু বেআইনি বা প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার নয়, বরং তা বাংলাদেশের সংবিধান, সিভিল সার্ভিস বিধিমালা ও আন্তর্জাতিক ন্যায্য বিচার মানদণ্ডেরও পরিপন্থী।
১. ঘটনাপ্রবাহের পটভূমি
মহাপরিচালক মহোদয়ের চাকরির মেয়াদ: নিয়মিত নিয়োগের ভিত্তিতে তাঁর মেয়াদ এখনো প্রায় ২ বছর ৬ মাস বাকি রয়েছে।
* অডিট আপত্তির প্রকৃতি: এটি একটি প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণমাত্র, যা আপিলযোগ্য ও নিষ্পত্তিযোগ্য। এটি ফৌজদারি অভিযোগ নয় এবং এর ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত কোনো আদালতের রায় বা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।
* জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ: একতরফাভাবে অডিট আপত্তিকে ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে রেলওয়ে মহাপরিচালক পদ থেকে অপসারণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
২. আইনানুগ বিশ্লেষণ: মহাপরিচালক পদে অপসারণ কেন বেআইনী
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮
* বিধি ৩(ক): অনিয়ম বা অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে যথাযথ তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কোনো কর্মকর্তাকে অপসারণ করা বেআইনী।
* বিধি ৫: শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে শোকজ, লিখিত জবাব, এবং শুনানির সুযোগ প্রদান আবশ্যক।
– তথ্যসূত্র: সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮
সংবিধানিক বাধ্যবাধকতা
* ৩১ অনুচ্ছেদ: প্রতিটি নাগরিক আইনানুগ সুরক্ষা ও প্রাকৃতিক বিচার প্রক্রিয়ার অধিকার ভোগ করেন।
* ৩২ অনুচ্ছেদ: কাউকে জীবন, স্বাধীনতা বা চাকরি থেকে আইনবহির্ভূতভাবে বঞ্চিত করা যাবে না।
* ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ: প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও প্রতিষ্ঠানগত স্বায়ত্তশাসনের নীতিমালার মাধ্যমে রেলওয়ের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার সংরক্ষিত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক রেফারেন্স
* আইএলও কনভেনশন নং-১৫৮, আর্টিকেল ৪:
“ A worker shall not be terminated unless there is a valid reason connected with the capacity or conduct of the worker or based on the operational requirements. ”
* ইউএন গাইডলাইনস অন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জাস্টিস (১৯৯৭):
প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, কারণ দর্শানোর সুযোগ এবং নিরপেক্ষ পুনর্বিবেচনার অধিকার থাকতে হবে।
৪. উচ্চ আদালতের দৃষ্টান্ত ও স্থগিতাদেশ
* মামলা: সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বনাম আব্দুল কুদ্দুস (রীট পিটিশন নং-৭২৬৫/২০২২)
* আদালতের পর্যবেক্ষণ: “কোনো পূর্ণাঙ্গ তদন্ত বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়াই দুর্নীতির অভিযোগে পদচ্যুতি অসাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার।”
* ফলাফল: অপসারণ আদেশ স্থগিত রেখে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ প্রদান করা হয়।
* বর্তমান প্রেক্ষাপট: হাইকোর্টে রিট দায়েরের প্রস্তুতি চলমান; বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির পক্ষ থেকে স্ট্যাটাস কু বা স্টে অর্ডার চাওয়ার পূর্ণ আইনগত ভিত্তি রয়েছে।
৫. মহাপরিচালক রেলওয়ের প্রশাসনিক অবস্থান ও দায়িত্ব
মহাপরিচালক রেলওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা, আধুনিকায়ন এবং রেল নীতিমালার বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। অডিট আপত্তির ভিত্তিতে তাঁর অপসারণ রেলওয়ের নীতিনির্ধারণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও নেতৃত্ব কাঠামোকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করবে।
৬. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আচরণ কেন সন্দেহজনক ও অনৈতিক
* অডিট আপত্তির অপব্যাখ্যা: এটি সাধারণত অর্থ মন্ত্রণালয় ও হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের দপ্তরে পর্যালোচনাযোগ্য; এটিকে ফৌজদারি দুর্নীতির অভিযোগ হিসেবে ব্যাখ্যা করা একটি বিভ্রান্তিমূলক প্রশাসনিক কৌশল।
* মালাফিডে ইন্টেনশন: মহাপরিচালক পদে পরিকল্পিত হস্তক্ষেপ করে অনুগত বা সুবিধাপ্রাপ্ত কোনো পক্ষকে বসানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
৭. বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির অবস্থান ও দাবি
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি নিম্নলিখিত অবস্থান গ্রহণ করছে:
১. মহাপরিচালক রেলওয়ের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ তদন্ত ও শুনানির মাধ্যমে আইনানুগভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে।
২. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একতরফা অপসারণ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
৩. রেলওয়ের নিজস্ব স্টেকহোল্ডার ও নীতিনির্ধারকদের সম্মতি ছাড়া মহাপরিচালক পদে কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না।
৪. প্রয়োজনে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করে মহাপরিচালক-এর সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির চুড়ান্ত ঘোষণা:
বর্তমান মহাপরিচালকের মেয়াদ ২০২৮ সাল পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আদালতের রায়, দুদকের ব্যবস্থা বা ফৌজদারি অভিযোগ ছাড়াই তাঁকে অপসারণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সংবিধান, সিভিল সার্ভিস বিধিমালা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থী। এটি কেবল একজন কর্মকর্তার প্রতি অন্যায় নয়, বরং সমগ্র রেলওয়ের প্রতিষ্ঠাগত স্থিতি, পেশাদার নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতিতে এক গুরুতর আঘাত।
এ অবস্থায় বিভিন্ন সূত্র থেকে রেলওয়ে মহাপরিচালক অপসারণের গুজবের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে রেল সচিবকে আহ্বান জানানো হয় অন্যথায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যদি এহেন কোন হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে আইনগত প্রতিকার নিশ্চিত করবে।
Design & Developed By: ECONOMIC NEWS
Leave a Reply